মালিবাগ-খিলগাঁও হয়ে মতিঝিল-গুলিস্তান পর্যন্ত চক্রাকার বাস চালু কি সম্ভব

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

হাতিরঝিল চক্রাকার বাস সার্ভিসের ৫ নম্বর কাউন্টারে টিকিট কাটছেন এক যাত্রীছবি: প্রথম আলো

বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের প্রধান কার্যালয়, বড় বড় করপোরেট অফিস ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকায় মতিঝিলকে ঢাকার অফিস পাড়া বলা হয়ে থাকে। মতিঝিল, গুলিস্তান ও পল্টনের সমন্বয়ে পুরো এলাকাটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা। তা ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ, মিটফোর্ড মেডিকেলসহ পুরান ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম সহজতর পথ হলো এই মতিঝিল ও গুলিস্তান এলাকা। তা ছাড়া এখান থেকে দূরপাল্লার বাসসমূহও যাতায়াত করে থাকে, ফলে এলাকাটি পরিবহন খাতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমান প্রেক্ষাপট—

প্রতিদিন অফিস বা বাণিজ্যিক কাজে খিলগাঁও, মালিবাগ, রামপুরা, বনশ্রী ও বাসাবো এলাকা থেকে যাঁরা মতিঝিল-গুলিস্তান এলাকায় যাতায়াত করেন, তাঁদের দুর্ভোগের সীমা নেই। ফুটপাতে অবৈধ স্থাপনা, রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আর টেম্পোর উৎপাতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মালিবাগ থেকে খিলগাঁও পর্যন্ত প্রধান সড়কের দুই পাশেই ফুটপাত দখল। আবার শহীদ বাকি সড়ক (খিলগাঁও তালতলা প্রধান সড়ক) দিয়ে খিলগাঁও রেলগেট পর্যন্ত সড়কের অবস্থাও একই রকম। এই সড়কে ফুটপাত দখলের পাশাপাশি ফুটপাত প্রশস্ত নয় ও চলাচলের অনুপযোগী। এরপর খিলগাঁও রেলগেট থেকে শুরু করে শাহজাহানপুর মোড়, রাজারবাগ সিগন্যাল, ফকিরাপুল, দৈনিক বাংলা হয়ে মতিঝিল, গুলিস্তান বা পল্টন অভিমুখে যেদিকেই যান না কেন, ফুটপাত দখলের কারণে হাঁটার ইচ্ছা থাকলেও তা অসম্ভব। এই পরিস্থিতিতে ওই রুটে হাতিরঝিলের অনুরূপ চক্রাকার বাস সার্ভিস চালুর মাধ্যমে যাতায়াতে অধুনিকতা, স্বস্তি ও পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে।

হাতিরঝিলের চক্রাকার বাস সেবা।
প্রথম আলো ফাইল ছবি

অতীত অভিজ্ঞতা—

চক্রাকার বাস সার্ভিসের প্রসঙ্গ এলে শুরুতেই মাথায় আসে হাতিরঝিল চক্রাকার বাস সার্ভিসের কথা। একসময়ের পরিত্যক্ত ও জনবিরল হাতিরঝিল আজ ঝলমলে ও প্রশান্তির এক টুকরা আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে হাতিরঝিলের অবৈধ দখল উচ্ছেদ, সুন্দর অবকাঠামো আর সুশৃঙ্খল পরিবহনব্যবস্থার কারণে। ২০১৫ সালের ২৩ ডিসেম্বরে ৪টি বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই বাস সার্ভিস যুক্ত করেছে রামপুরা, মহানগর প্রজেক্ট, মধুবাগ, মগবাজার, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, অভিজাত এলাকা গুলশান ও মেরুল বাড্ডাকে। ঢাকার পরিবহনব্যবস্থায় একটি সফল ও সুশৃঙ্খল বাস্তবায়ন এই হাতিরঝিল চক্রাকার বাস সার্ভিস।

সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা—

মালিবাগ-খিলগাঁও থেকে মতিঝিল-গুলিস্তান পর্যন্ত চক্রাকার বাস চালুর লক্ষ্যে প্রথমেই এই প্রকল্পের জন্য একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি। কারণ, এটি একটি পরিবহনব্যবস্থা হলেও এর সঙ্গে অত্র এলাকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান, পরিবেশগত পরিবর্তন, ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের পরিবর্তনের বিষয়গুলো সম্পৃক্ত।

জনসংযোগ—

এলাকাবাসী এই বাস সার্ভিসকে কীভাবে গ্রহণ করবে, তার পরিসংখ্যানিক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে হবে। যেহেতু হাতিরঝিল চক্রাকার বাস প্রকল্পের সফলতার অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে, এই অভিজ্ঞতার আলোকে এলাকাবাসী অবশ্যই এই চক্রাকার বাস সার্ভিস চালুর ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দেবেন। বর্তমান পেক্ষাপটে এলাকাবাসীও অনুরূপ একটি বাস সার্ভিস প্রত্যাশা করছে।

বিধিমালা প্রণয়ন ও নিয়োগ—

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সব পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে বিধিমালা প্রণয়ন করতে হবে। প্রকল্প এলাকার মধ্যে কোনো প্রকার অবৈধ স্থাপনা না থাকা, পায়েচালিত ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলতে না দেওয়া এবং টেম্পোর বিকল্প হিসেবে চক্রাকার বাসকে প্রতিস্থাপিত করার ব্যাপারে কঠোর বিধিমালা প্রণয়ন এবং তা কার্যকর করার ব্যাপারে শক্তিশালী প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন ও ট্রাফিক বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সবার সদিচ্ছা ও সম্পৃক্ততার মাধ্যমে প্রকল্পের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হবে।

রুটম্যাপ—

প্রাথমিকভাবে খিলগাঁও (মালিবাগ) কমিউনিটি সেন্টার থেকে যাত্রা শুরু করে শহীদ বাকি সড়ক দিয়ে খিলগাঁও রেলক্রসিং পার হয়ে শাহজাহানপুর মোড় পর্যন্ত এসে সেখান থেকে একটি রুট হতে পারে সোজাসুজি ফকিরাপুল-দৈনিক বাংলা-রাজউক পর্যন্ত। অন্যদিকে শাহজাহানপুর পর্যন্ত এসে অপর রুটটি হতে পারে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে দিয়ে নটর ডেম কলেজ হয়ে মাতিঝিল শাপলা চত্বর পর্যন্ত। এতে করে খিলগাঁও, মালিবাগ, রামপুরা, বনশ্রী এলাকা থেকে যাঁরা প্রতিনিয়ত মতিঝিল, গুলিস্তান, পল্টন, পুরান ঢাকা এলাকায় অফিস ও ব্যবসাকার্য পরিচালনার জন্য যাতায়াত করেন, তাঁদের সুবিধার পাশাপাশি এসব এলাকায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরাও উপকৃত হবেন। যানজট কমবে, জনগণের ভোগান্তি লাঘব হবে, কর্মঘণ্টার সাশ্রয় হবে, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আসবে, পরিবেশ হবে স্বাস্থ্যকর।

অবকাঠামোগত উন্নয়ন—

হাতিরঝিল চক্রাকার বাস সার্ভিসের অবকাঠামোর আদলে আমরা এই প্রকল্পের অবকাঠামোগত পরিকল্পনা করতে পারি। সড়ক উন্নয়ন, ফুটপাত চলাচলের উপযুক্তকরণ, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, রুটম্যাপের আওতাধীন সড়কে রিকশা ও টেম্পো চলাচল বন্ধকরণ, যাত্রীছাউনি ও টিকিট কাউন্টার স্থাপন, ওয়ার্কশপ স্থাপন, প্রশাসনিক কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করার কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে।

পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান—

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং বিষয়। চক্রাকার বাস সার্ভিস চালু হলে এই রুটে আগে থেকে চালু থাকা টেম্পো সার্ভিস ঝুঁকিতে পড়বে। প্রকল্পের কর্মপরিপল্পনায় তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ রাখতে হবে। টেম্পোচালকদের চক্রাকার বাস সার্ভিসে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে, যাতে তাঁদের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। টেম্পোমালিকদের চক্রাকার বাস সার্ভিসের সঙ্গে শেয়ারভিত্তিক অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা সম্ভব। এই পক্ষকে মোটিভেশন ও অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে চক্রাকার বাস সার্ভিসের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারলে আলোচ্য বাস সার্ভিসের কাজটি সহজসাধ্য হবে বলে মনে করি।

শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য ও নিরাপত্তা—

গণপরিবহনব্যবস্থার আধুনিকায়নের পাশাপাশি ওই প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য থাকবে প্রকল্প এলাকার শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা বিধান করা। চক্রাকার বাস সার্ভিস চালুর ফলে বিকল্প কর্মসংস্থানের আওতায় এলাকার রিকশাচালক বা হকার শ্রেণির পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ওই কাজে সম্পৃক্ত করা সম্ভব। সমন্বিতভাবে সার্বিক প্রকল্পের মানোন্নয়ন ও জনবান্ধব প্রকল্প গড়ে তুলতে পারলে প্রকল্প সফল ও জনপ্রিয়তা পাবে।

তদারকি ও উন্নয়ন—

মালিবাগ-খিলগাঁও হয়ে মতিঝিল-গুলিস্তান পর্যন্ত চক্রাকার বাস সার্ভিসের সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করবে এর সঠিক ও পরিকল্পনামাফিক তদারকির মাধ্যমে। তদারকি কাজগুলোর মধ্যে ফুটপাত পায়ে হাঁটার উপযোগী রাখা, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, সৌন্দর্যবর্ধন, নিরাপত্তা রক্ষার মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে।

সার্বিক দিক বিবেচনায় সরকার ও পরিবহন উদ্যোক্তাদের উচিত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা যাচাই করা। রাজধানী ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারের চেষ্টাকে সফল করার লক্ষ্যে আলোচ্য রুটে চক্রাকার বাস সার্ভিস হতে পারে আরেকটি কার্যকর পদক্ষেপ। কঠোর তদারকি ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের সহযোগিতা থাকলে এই রুটটিকে দেশের অন্যতম সুশৃঙ্খল পরিবহনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

লেখক: সাজ্জাদ হোসেন রিজু, ব্যাংক কর্মকর্তা, খিলগাঁও, ঢাকা।