জেন-জির প্রতি একজন জেন-এক্সের খোলা চিঠি
৪৪ বছর বয়সের এই আমি গত দুই রাত জেগে কাটালাম ডাকাত–আতঙ্কে। গত রাতে ছেলেকে নিয়ে টহল দিলাম মহল্লার রাস্তায়। এ কেমন স্বাধীন দেশ, বাবা? প্রশ্ন করে সে। আমার ছেলের বয়স ১৭ বছর, সে আমার সেরা বন্ধু। তাকে গত ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বাসা থেকে বের হতে দিইনি পুলিশের ও ছাত্রলীগের ভয়ে। রাস্তায় বেরিয়ে নিজেকে ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিতে পারব না, এ কেমন দেশ, বাবা? প্রশ্ন করেছিল সে। তার জবাবে আমার এই খোলা চিঠি, যাতে বাংলার গোটা প্রজন্ম-জেডকে আমার কিছু বলার আছে।
প্রিয় জেন-জি
২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকের কথা। আমার স্ত্রী তখন ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এমন সময় চলছিল তৎকালীন বিরোধী দলের আন্দোলন। তারা বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। ঢাকায় চলছিল হরতাল। গাড়ি বের হলেই ভেঙে দিচ্ছিল পিকেটাররা, অ্যাম্বুলেন্সকেও ছাড় দেওয়া হচ্ছিল না। সরকার (তৎকালীন বিএনপি) তার ক্ষমতা ছেড়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে নির্বাচন হতে দেবে না। বিরোধী দল দাবি আদায় করে ছাড়বে যেকোনো মূল্যে। বঙ্গবন্ধুর চিরভক্ত এই আমি তখন আওয়ামী লীগকে শাপশাপান্ত করছিলাম। আমার স্ত্রীকে নিয়ে সেই দুর্যোগে কীভাবে হাসপাতালে যাব, তার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় ১১ জানুয়ারি রাতে এল এক ঘোষণা। সেটাকে সবাই ১/১১ নামে ডাকে। আমি ডাকি মুক্তির দিন। একদিকে তৎকালীন সরকার (হাওয়া ভবন ছিল তাদের সাম্রাজ্যের হেড কোয়ার্টার), অন্যদিকে জেদি বিরোধী দল (ক্ষমতায় যাওয়াই ছিল যাদের মূল লক্ষ্য)। তাদের হাত থেকে দেশবাসীকে মুক্তি দিল সেনাবাহিনী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আমি তখন দৈনিক প্রথম আলোর আনিসুল হক ভাই বরাবর আমার প্রথম প্রবন্ধটি পাঠিয়েছিলাম। সেটা ‘বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্ন সত্যি হবে তো?’ নামে ছাপা হয়েছিল।
প্রিয় জেন-জি
ফিরে আসি বর্তমানে। আজ থেকে ১ মাস আগেও গর্ব করে বলতাম, বাংলাদেশকে যিনি শাসন করছেন, তাঁকে ছাড়া এদেশ অচল। মেট্রোরেল বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চড়ে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতায় হৃদয় উদ্বেলিত হতো। পদ্মা সেতুতে চড়ে স্মৃতির শহর খুলনায় যাওয়ার সময় আবেগে উচ্ছ্বসিত হতাম। এরপর দেশে ঘটে গেছে অনেক বড় একটি ঘটনা। আমার মনের ভেতর এসেছে এক বিপ্লব। শান্ত আমি ক্রমেই অশান্ত ও দুর্বিনীত হয়ে উঠেছি। তবে সেটা পুরোপুরি আমার মনোজগতে। আমার আচরণে তার কোনো প্রকাশ নেই।
কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন দানা বাঁধছিল, আমি তখন নতুন একটি বেসরকারি চাকরিতে সদ্য যোগ দিয়েছি। দিন কাটছিল সীমাহীন ব্যস্ততায়। দেশের খবর রাখছিলাম ভাসা ভাসা। মনে মনে চিরকাল আমি কোটাকে ঘৃণা করেছি মেধার অবমূল্যায়ন হয় বলে। তাই হঠাৎ যেদিন কানে এল, এই আন্দোলনকে ‘অযৌক্তিক’ আখ্যা দিয়েছেন স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান, আমি শুরুতে অবাক হলাম, পরে বুঝলাম তিনি চান একটা তাবেদার ও মেধাহীন রাষ্ট্রযন্ত্র গঠন করতে, যারা আজীবন ‘যায় যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান’-এর মতো মন্ত্র জপতে থাকবে। এরপর যখন তিনি তোমাদের ‘রাজাকারের নাতি’ বললেন, বুঝলাম, তিনি এই তরুণ প্রজন্মকে কেমন মূল্য দেন। ছাত্রদের পদদলিত করতে তাঁর সেই হেলমেট বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া, পুলিশকে পথে পথে গুলি করার নির্দেশনা এবং ফলে সাঈদ, মুগ্ধ, প্রিয়সহ শত শত প্রাণের আত্মাহুতি আমাকেও মনে মনে বিদ্রোহী করে তুলল। হাসপাতালে আহত মানুষের ঢল আমাকেও মর্মে মর্মে আহত করল। আমি তবু নিশ্চুপ। কারণ, আমাকে চুপ থাকতে বলা হয়েছে।
প্রিয় জেন-জি
তবু জেনে রোখো, ২০১৩ সালের গণজাগরণে আমি অনলাইনে শাহবাগে সোচ্চার ছিলাম। নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে আমি সরকারের বিরোধিতা করে ফেসবুকে ও রাস্তায় নেমেছিলাম। ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া, ইলিশ পাঠানো বা ভারতীয় তারকা দিয়ে বাংলাদেশে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ আমাকে উদ্বিগ্ন ও উত্ত্যক্ত করেছে। এরও আগে যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ছলাকলায় যে কাউকে যেকোনো সময় স্তব্ধ করে দিয়েছেন, আমার মন বিদ্রোহ করেছে (আমিও লেখার স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম)। বিডিআর বিদ্রোহী বা সাগর-রুনি হত্যা আমাকে সরকারবিদ্বেষী করেছে। আয়নাঘরের নাম শুনে রক্ত হিম হয়ে গেছে বহুবার। আমি তবু চিরকাল শান্ত ছিলাম। ভারতীয় ঋণের টাকায় হাইটেক পার্ক নির্মাণের প্রকল্পের সঙ্গে আমি সরাসরি যুক্ত ছিলাম। প্রত্যক্ষ করছিলাম কী বিপুল অর্থের অপচয় ও পাচার করার এক নীলনকশা ছিল সেটি। সে প্রসঙ্গ আজ থাক।
কিন্তু ২০২৪ এর এই জুলাই মাসটা যেন মহাকালের এক অবিস্মরণীয় এক ফালি অন্ধকার, যা সূর্য গ্রহণের মতো গোটা পৃথিবীকে সাময়িকভাবে ঢেকে দিয়েছিল নিকষ কালো আঁধারে। প্রতিদিন এত এত প্রাণ যায়, জুলাই মাস যেন ফরোয় না। ১৮ জুলাই যখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ডাকল, আমি যেদিনই সেনা মোতায়েন হবে আশা করেছিলাম। ঘটল তার উল্টোটা। কোথা থেকে কারা এসে বিটিভি ভবন হামলা করল। এরপর যাত্রাবাড়ী উড়ালসেতু, বিআরটিএ, সেতু ভবন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল আক্রান্ত হলো। ইন্টারনেট বন্ধ করা হলো। আন্দোলনকারীরা এবার পরিণত হলো মেশিন গান আর স্নাইপার রাইফেলের নির্মম টার্গেটে। অপর দিকে বিরোধী দলের সব কর্মীরা বেছে বেছে গ্রেপ্তার হলেন। লাশ পড়ল রাস্তায়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হলো কলংকিত, হাসপাতালগুলো আহত ব্যক্তিদের আর্তনাদে প্রকম্পিত। মর্গে লাশের স্তূপ। পথে পথে নেমে এল সর্বস্তরের জনগণ।
এদিকে মাছের মায়ের তখন পুত্রশোক। জীবনে যা করিনি, তাই শুরু করলাম। সেই রাক্ষসীর মৃত্যু কামনা। সেই দোয়া করতাম প্রতি রাতে নামাজের পর বিশেষ সিজদায়। আমার মতো কোটি মানুষ তাই করেছেন, আমি জানি। তাই তো অবশেষে এল চূড়ান্ত বিজয়। দিনটাকে ২০২৪ সালের ক্যালেন্ডার বলে ৫ আগস্ট, তোমরা বল ‘৩৬ জুলাই’। সেদিন সকালে আমি ও আমার পরিবার লাউড স্পিকারে জাগরণের গানগুলো শুনছিলাম। ‘শোষণের দিন শেষ হয়ে আসে/ অত্যাচারীরা কাঁপে আজ ত্রাসে’ শুনে ধমণীতে রক্ত ফুটছিল টগবগ করে। হালের ইউটিউবের ‘দেশটা তোমার বাপের নাকি?’ যেমন শুনছিলাম, ১৯৭১–এর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’-ও শুনছিলাম। কখনো বা নজরুলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুনছিলাম, কখনো–বা নিজেই শামসুর রাহমানের ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ আবৃত্তি করছিলাম। এ সবের মাঝখানেই এক সহকর্মী ফোন করে জানালেন, স্বৈরাচার পতনের সেই অতি কাঙ্ক্ষিত সুসংবাদ। টিভি খুলে সেটা নিশ্চিত হওয়ার পর আমি ছুটে গেলাম মিষ্টির দোকানে...।
অথচ আমার পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক বলয়ে প্রায় সবাই বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। দেশ পরিচালনায় তাঁর ব্যর্থতা ভুলে আমরা স্বাধীনতার ডাক দেওয়া এক অমোঘ নেতৃত্বকে চিরকাল মনে রেখেছি, শ্রদ্ধা করেছি। ১৫ আগস্ট সত্যিই মনটা ভারাক্রান্ত থাকে প্রতিবছর। তবে দেশজুড়ে তাঁর মূর্তি (এটাকে নাকি ভাস্কর্য বলতে হয়!) কোন দিন মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। মানতে পারিনি সবখানে তাঁর নাম যুক্ত করা। মানতে পারিনি ব্যক্তিপূজার এই গভীর ও ব্যাপক তোড়জোড়, সেই ১৯৯৬ সাল থেকে যার শুরু। তবু আজ যখন কেউ সেসব মূর্তি ভাঙছে, মুর্যাল ধ্বংস করছে, তাঁর নাম মুছে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানের ফলক বদলে যাচ্ছে—আমার খারাপ লাগছে। আজ যখন গণভবনে চলছে ভাঙচুর, লুটপাট—আমার কষ্ট হচ্ছে। বিদেশি মিডিয়া যখন সেসব ছবি প্রচার করছে, লজ্জায় আমার মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে।
তোমরা চেষ্টা করে যাচ্ছো। আমি বিশ্বাস করি, তোমরা পারবে। আমরা পারিনি। আমাদের এত দেরি হলো মানব আর দানবের প্রভেদ বুঝতে? আমরা তো অনেক আগে থেকেই সিন্ডিকেটের কারসাজি, সরকারের সর্বস্তরে দুর্নীতি আর নেতাদের সীমাহীন আধিপত্যকে ঘৃণা করেছি। আমি জীবনে একবার মাত্র ভোট দিয়েছি, সেটাও ‘না-ভোট’। এরপরের তিন নির্বাচনে তো ভোট দিতেই যাইনি। গেলেও কি দিতে পারতাম? সেই ভোটাধিকার তো কবেই হারিয়েছিলাম। তারপরও প্রকাশ্যে এই দলের প্রতি বিষোদ্গার করিনি। সাহস পাইনি। তোমাদের এই সম্মিলিত দুঃসাহসকে তাই জানাই লাল সালাম।
৮ আগস্ট নতুন অন্তর্বর্তী সরকার শপথ গ্রহণ করেছেন। প্রবীন ও নবীনের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে দেশের এক অভিনব অভিভাবক। তোমরা রাস্তায় ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছ, যা দেশবাসীকে অভিভূত করেছে। পুলিশ বাহিনী না ফেরায়, তোমরা রাত জেগে মহল্লায় মহল্লায় টহল দিচ্ছে। নতুন এক বাংলাদেশ একটু একটু করে রূপ নিচ্ছে। কিন্তু যখন দেখছি শাপলা চত্বরের নাম ‘শহীদি চত্বর’ করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম, দোকানে দোকানে ছাত্রদলের নেতারা শুরু করেছে চাঁদাবাজি, হাওয়া ভবনের হোতা আজ ভালো মানুষটি সেজে দাঁড়াতে চাইছে নতুন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার তীব্র বাসনায়, তখন আবার বুক কেঁপে ওঠে। যখন দেখি গোপালগঞ্জে এখনও রামদা-লাঠি নিয়ে মিছিল হয়, আমি আবার হতাশ হয়ে যাই। মাঝেমধ্যে মনে হয়, পুরো আন্দোলনটা একটা ছকে ফেলা ঘটনাপ্রবাহ। এক পক্ষ যখন চলেছে গতানুগতিক ক্ষমতার অন্ধ অহংকারকে পুঁজি করে (তাই একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের ধ্বংস ডেকে এনেছে), অপর পক্ষ তখন চৌকসভাবে একের পর এক দাবার চাল দিয়েছে প্রতিপক্ষকে টোপ দিয়ে দিয়ে। ‘বাংলাদেশ ২.০’ কি তবে সাময়িক সাফল্যের জন্য সৃষ্টি হলো? তবে কি এক দেশের দাস এবার পরিণত হবে অন্য দেশের দাসে? নাকি চীন আর আমেরিকার রুটি-ভাগের কাড়াকাড়িতে বলির পাঁঠার মতো কাটবে আমাদের অনাগত বছরগুলো? তবে কি স্বৈরাচারের পতনের এই আন্দোলনে তোমরা শুধুই দাবার ঘুঁটি? নেপথ্যে চাল চালছিল অন্য কোনো মাস্টারমাইন্ড?
এর জবাব তোমরাই দেবে। অপেক্ষায় রইলাম। তোমাদের মুখ চেয়ে আশায় বুক বেঁধে আছে গোটা দেশ। মহান আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।
* লেখক: পথিক কাজী (ছদ্মনাম), ঢাকা
*(লেখাটি ৯.৮.২০২৪ –এ লেখা)
*নাগরিক সংবাদে ছবি, লেখা ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]