প্রিয় দেশ; আমিও তোমায় ভালাবাসি
কখনো ঘোর অমানিশা ভীতি সঞ্চার করে, কখনো অন্ধকার কেটে নতুন সূর্যোদয় দেখা দেয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আমাদের তা দেখিয়ে দিয়েছে। আন্দোলনের শেষ দিকে প্রতিটি দিন আতঙ্কে কেটেছে। ভয়ে অনেকেই বাসা থেকে বের হতে চাননি। কয়েক দিন অফিস বন্ধ ছিল, রাস্তাঘাটে চলাফেরায় এক অজানা আতঙ্ক কাজ করেছে। মাঝেমধ্যে মিছিলের আওয়াজ শোনা যেত। চারদিকে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। একদিকে আন্দোলনরত ছাত্ররা, অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ভালো ছিল না আমাদের বাংলাদেশ, ভালো ছিল না প্রিয় স্বদেশ। দেশটির ক্ষতবিক্ষত চেহারা ছিল। এ ক্ষত শুকানোর নয়। যে ক্ষত নিয়ে ১৯৭১ সালে যাত্রা শুরু হয়েছিল, সে ক্ষত এখনো মাঝেমধ্যে উঁকি দেয়। তাই কিছুদিন পরপর বেদনাহত হতে হয় প্রিয় জন্মভূমিকে। আন্দোলনের নামে বারবার বেদনার গ্লানি পোহাতে হয়। কোনোটা বেগবান হয়, কোনোটা গতিহীন পথে হারিয়ে যায়। কিন্তু মাঝেমধ্যে রক্তরাঙা ভোর না বলা কথা দেখিয়ে দেয়। দেখিয়ে দেয় আমাদের দেশের ছাত্রসমাজ কীভাবে একটি সুন্দর দেশ গড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে যায়। অনেক ত্যাগ–তিতিক্ষার বিনিময়ে, রক্তের বিনিময়ে, প্রাণের বিনিময়ে তা সম্ভব হয়েছে। আন্দোলনে অনেক প্রাণহানি ঘটেছে যা অত্যন্ত দুঃখজনক, একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনার উদ্দেশ্যে ছাত্রদের এমন ত্যাগ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে গেলেও রক্তের দাগ শুকায়নি। মুছে যায়নি দেশের বিদগ্ধ চেহারা। তাই অমানিশার প্রহর দেখতে হচ্ছে বারবার। ক্ষতবিক্ষত হয়ে দাঁড়াতে পারছে না প্রিয় দেশ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মনুষ্যঘটিত কার্যকলাপ বারবার দেশটিকে আঘাত করছে। দেশটির উন্নয়নে সামাজিক হিংসা ও বৈষম্য সমাজে কোভিডের মতোই অতিমারির আকার ধারণ করেছে। তাই কখনো কখনো দেশে সহিংসতা দেখা দেয়, দেশের মানুষ রক্তাক্ত হয়, দেশের সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
‘বাঙালি’ শব্দটি আমাদের ভেতর যেন এক ক্ষণপ্রভায় আলোড়িত হয়ে ওঠে। একটা বাস্তব গল্প নিয়ে রচিত হয়েছিল আমাদের বীর বাঙালি জাতির আত্মগৌরবের কথা, যাতে ছিল ছোট ছোট স্বপ্নমিলনের বাস্তবিক রূপ। কখনো কখনো ঝড়-ঝঞ্ঝা আমাদের এলোমেলো করে দেয়। তারপরও কোনো না কোনোভাবে সেসব সামলে দেশ এগিয়ে যায়।
ইতিমধ্যে আন্দোলনের মাধ্যমে ইতিবাচক অনেক দাবি আদায় হয়েছে। এখন আমরা চাই, সবাই সুন্দর পরিবেশে গড়ে উঠুক। হঠাৎ যেন কোথাও ভয়ংকর শব্দে ভীত হয়ে না উঠি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন পরিবেশ–পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত না হয়। নিরাশা যেন তাদের তাড়া না করে। আমাদের মননে যেন চিড় ধরাতে না পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা বৈরী সামাজিক গতিবিধি, আমাদের সঠিক নিশানাকে যেন বিচ্যুত করতে না পারে। তাহলেই বাঙালি জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। সে জন্য দেশপ্রেমকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। পাশাপাশি মানবিকতাকে অন্তর দিয়ে তা লালন করতে হবে।
বিভেদ ও বিবাদ যেমন সমাজে ঘুণ ধরায়, তেমনি দেশের উন্নয়নের পথেও কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে, নাগরিকের স্বার্থে সামাজিকভাবে রাষ্ট্র পাশে থাকলে সে দেশের প্রত্যেক জনগণ উন্নয়নের ফল ভোগ করে। তাই নিজের স্বার্থে নয়, দেশের কথা ভেবে দেশকে ভালোবাসতে হবে। সে জন্য সব রকম ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে গিয়ে অকৃত্রিমভাবে দেশ ও দেশের জনগণকে ভালোবাসতে হবে। পাশাপাশি আমাদের চিন্তা করার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, পোশাক পরার স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, গান করার স্বাধীনতা, স্বপ্ন দেখার স্বাধীনতা থাকতে হবে। তা যত কঠিন হবে, ততই একমাত্রিক হয়ে যাব আমরা। অথচ দেশচেতনা বহুমাত্রিক। আমরা এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি। আন্দোলন শেষ হওয়ার পর দেশের মধ্যে যেসব সহিংসতা ঘটছে, তা কাম্য নয়। এই বৈরী অবস্থা মোকাবিলায় আমাদের মানবিক শক্তিকে জাগাতে হবে, সমাজকে পরিশুদ্ধ করতে হবে।
বিভিন্ন স্থানে হিন্দু–অধ্যুষিত এলাকায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে (প্রথম আলো; ৮ আগস্ট, ২০২৪)। তা থেকে রক্ষা পেতে বিভিন্ন জায়গায় ছাত্ররা পাহারা দিচ্ছেন। বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীরা ভালো কাজ করে আমাদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন। তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন। বিভিন্ন স্থানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ তাঁরা নিজেরাই চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া দেশের অর্থনীতি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অর্থনীতি যেন আর ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য দেশের নাগরিকদের সর্বোপরি সোচ্চার হতে হবে। আমাদের আশা অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সহিংসতা কমে আসবে, অর্থনীতি গতি ফিরে পাবে। দেশের জনগণের ভয়-ভীতি কেটে যাবে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠিত হবে।
আন্দোলনপরবর্তী সহিংসতায় অনেকের প্রাণহানি ঘটেছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। কখনো তা কাম্য হতে পারে না। মানুষের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হোক। আমরা চাই, শত ফুল বিকশিত হোক। আর একটি প্রাণও যেন ঝরে না পড়ে। ঝরে পড়া মানে আমাদের অন্তরে ক্ষত সৃষ্টি করা। আর যেন ভেদাভেদ উসকে না ওঠে। সুন্দর দাবি যেন আমরা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারি। সুষ্ঠুভাবে তা যেন সমাধানের পথ হয়ে ওঠে। প্রত্যেক নাগরিকই যেন নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলতে পারে। সীমাবদ্ধতার ভেতর কেউ যেন আরও সীমাবদ্ধ হয়ে না পড়ে। তবেই সুজিত সরকারের ভাষায় বলতে পারব,
‘দেয়াল তুললেই ঘর—
ভেঙে ফেললেই পৃথিবী।’
আমরা চাই মাথাচাড়া দিয়ে যেন উঠতে না পারে নষ্ট সমাজের ছত্রচ্ছায়া। কারণ, নেতিবাচক সমাজব্যবস্থা আমাদের শঙ্কিত করে তোলে। যার ফলে সমাজে দেখা দেয় ছন্দপতন। সে জন্য আমরা শান্ত ও নিরাপদ সমাজ চাই। যেখানে থাকবে না কোনো হানাহানি, থাকবে না কোনো ভেদাভেদ। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে। প্রতিবাদ হবে কিন্তু তা যেন জনজীবন রুদ্ধ না করে। তবেই আমরা দেশটাকে আপন করে নিতে পারব। অনুভব করতে পারব ‘One earth so green and round, who could ask for more?’ তবেই সাবলীল ভঙ্গিতে সবাই বলতে পারব, ‘প্রিয় দেশ; আমিও তোমায় ভালোবাসি! তোমাকে নিয়ে আমিও স্বপ্ন দেখেছিলাম।’
লেখক: অন্জন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা