ফেসবুক মিম: নিছক কৌতুক না আত্মতৃপ্তি
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই পরিবর্তিত হয়। সময়ের আবর্তে নতুন নতুন বিষয়ের আবির্ভাব ঘটে। মানুষ পুরোনো ফর্মগুলো ভুলতে শুরু করে আর নতুনকে আলিঙ্গন করে নেয়। ফেসবুকেও সে রকমই ঘটেছে বলে মনে হয়। বাংলা সংস্কৃতিতে ‘মিম কালচার’ এগিয়ে চলেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। যেকোনো সমসাময়িক বিষয় নিয়ে মজাদার ‘মিম’ ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিংবা হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের গ্রুপগুলোতে।
মিম এখন কেবল আর হাসিঠাট্টার বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। যোগাযোগ থেকে শুরু করে চলমান বিষয়াবলি, প্রচারণা, মার্কেটিং ও প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও মিম কনটেন্টের ব্যবহার বাড়ছে প্রতিনিয়ত। যারা দৈনন্দিন ঘটনার খবর রাখেন না, তারা মিমের বদৌলতে আশপাশে কী ঘটছে তা জানতে পারছেন। কেউ অবশ্য আবার মিম দেখে চট করে সেটার প্রসঙ্গ কী তা বুঝতে পারেন না। তবে এ রকম পরিস্থিতিতে ঘটনা প্রসঙ্গে ওয়াকিবহাল হতে অন্য নেটিজেনদের কমেন্টের ওপর দিব্যি ভরসা করা যায়।
কেন এত জনপ্রিয় মিম সংস্কৃতি
এটি তৈরি ও শেয়ার করা সহজ। যে কেউ মিম টেমপ্লেট নিয়ে ছবি এডিট করে কিংবা ক্যাপশন বসিয়েই মিম তৈরি করতে পারেন। চলমান ঘটনা থেকে খেলাধুলা কিংবা বিনোদনজগৎ—সবই হয়ে উঠেছে মিম টেমপ্লেট তৈরির মূল ভান্ডার। এত সহজ, সংক্ষিপ্ত ও হাস্যরসাত্মক মাধ্যম হওয়ায় মানুষ সহজেই একে গ্রহণ করতে পারে। দিন দিন তাই মিম পোস্টের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। এসব সুবিধার কারণেই মিম এত জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সমর্থ হচ্ছে।
সম্ভাবনাময় মিম সংস্কৃতি
হাস্যরসের মাধ্যমে সমাজের অসংগতি দেখিয়ে এবং বুঝিয়ে দেওয়া যায় সহজেই। মিম হয়ে উঠেছে সহজ ভাষায় জটিল জিনিস ব্যাখ্যা করার হাতিয়ার। সামাজিক মাধ্যমে মিমের সাহায্যে অনেক না বলা কথা ছড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে, যা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রিত মাধ্যমে সম্ভব নয়। মিমকে শিক্ষা উপকরণ হিসেবেও ভালোভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
সাম্প্রতিককালে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এ মিমসংস্কৃতি বিজ্ঞাপন দুনিয়ায়ও বেশ প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। নাটক, সিনেমা, ওয়েব সিরিজের প্রচারকাজে মিমের ব্যবহার বেড়েছে। একসময় নিছক বিনোদন ও হাসির খোরাক জোগানো মিম বর্তমানে প্রচারণা ও বিজ্ঞাপন দুনিয়ার বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ফলে বিভিন্ন ব্র্যান্ড, প্রতিষ্ঠান নিজেদের প্রচারণার জন্য মিম পেজগুলোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে।
নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কাছে মিমের ব্যবহার একটি আকর্ষণীয় পদ্ধতি হতে পারে। গুরুগম্ভীর কোনো বিষয়কে হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে ধরা, জটিল কোনো বিষয়কে মিমের মাধ্যমে সহজবোধ্য ভাষায় তুলে ধরা, কিংবা কেবল একঘেয়ে লেকচারের মধ্যে শিক্ষার্থীদের খানিকটা বিশ্রাম দিতেও মিমকে ব্যবহার করা যেতে পারে। ডকুমেন্টারি, ছবি কিংবা ইনফোগ্রাফিকের পাশাপাশি মিমকেও রাখা যেতে পারে শিক্ষাকে আরেকটু আনন্দময় করতে।
মিম যেন প্রতিবাদের হাতিয়ার
আজকে ‘মিম সংস্কৃতি’ হাস্যরসাত্মক হওয়ার পাশাপাশি, ব্যঙ্গাত্মক, চিন্তামূলক এমনকি প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। সমাজের অরাজকতা, দুর্নীতি, অপরাধ, ক্ষমতার অপব্যবহার খুব সহজেই ফুটিয়ে তুলতে পারে এই মিম কালচার। একটা লেখা পড়তে আপনার একঘেয়ে লাগতে পারে, ভিডিও চিত্র দেখতে আগ্রহ না–ও আসতে পারে। কিন্তু একটা মিম আপনার এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। এক লাইনের মধ্যে একটা ছবি আর দুই লাইন কথা লিখে দিলেই হয়ে যায়। আর আপনি যদি রিলেট করতে পারেন তার সঙ্গে, তাহলে নিছক মজা করার জন্য হলেও শেয়ার তো অবশ্যই করবেন। বন্ধুদের দেখাবেন, ট্যাগ দেবেন, ইনবক্স করবেন। ব্যস, চেইন রিঅ্যাকশনের মতো সেই মিমটা ছড়াতে শুরু করবে। তাই কেবল মুখেই নয়, নীরব পোস্টারও বহন করছে প্রতিবাদের বার্তা।
মিম তৈরিতে তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা
তরুণদের মধ্যেই মিম তৈরি ও চালাচালি করার প্রবণতা বেশি। অবশ্য মিমের মূল ভোক্তা ওই তরুণেরাই। তাই ইন্টারনেটের বিভিন্ন মিম পেজ-গ্রুপের সদস্যও বেশির ভাগ তারাই। এসব গ্রুপে যাঁরা মিম বানান, তাঁদের মধ্যেও যেন চলে একধরনের নীরব প্রতিযোগিতা। সেই মিমকেও কার্যত প্রতিবাদের ভাষা করে তুলেছে তরুণ প্রজন্মের দল। আর এ ধরনের সৃজনশীল কাজে যে যথেষ্ট মেধার প্রয়োজন, তা আশা করি সবাই বুঝতে পারছেন।
হাস্যরসাত্মক সব কৌতুকই মিম নয়
জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লিমন শিফম্যান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘হাসির খোরাক জোগানো কোনো ছবি ছড়িয়ে পড়লেই তাকে মিম বলা যায় না। বরং যেকোনো একটি ব্যাপারকে কেন্দ্র করে যখন সবাই তার নিজ নিজ ভার্সন তৈরি করে, তখন তা মিম হয়ে ওঠে।’ মূলত এটি এমন একটি ধারণা, আচরণ বা শৈলী, যা অনুকরণের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে সামাজিক রীতিনীতি, পরিবেশ, ঐতিহ্য ইত্যাদি ভূমিকা রাখে। আর যেসব ‘মিম’ উপযুক্ত পরিবেশ পায়, সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে ও টিকে থাকে।
দিন শেষে যখন বিরিয়ানিবিষয়ক কোনো মিমে নিজের বন্ধুকে ট্যাগ করেন বা স্কুল থেকে ফিরে স্কুল বা পড়াশোনাবিষয়ক কোনো মিম দেখে আপনার মুখে যদি হাসি ফোটে, তাহলে সেখানেই মিমের সার্থকতা। মিম আপনাকে হাসাবে, ভাবাবে, নস্টালজিক করবে, সর্বোপরি আপনার কথাটাকে পৌঁছে দেবে অন্য কিংবা অনেকের কাছে।
লেখক: শিক্ষার্থী, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।