নদী-নালায় সাকার মাছের বিস্তার: মানবসৃষ্ট সমস্যা

সাকার মাছের পিঠের ওপরে বড় ও ধারালো পাখনা আছে। দুই পাশেও রয়েছে একই রকমের দুটি পাখনা
ছবি: আসাদুজ্জামান

সাকার মাছ বা প্লেকো ফিশ, যার বৈজ্ঞানিক নাম হিপোসটোমাস প্লেকোসটোমাস। বর্তমানে কমবেশি সবাই মাছটিকে চেনেন। শক্ত মাথা, কালো শরীর, গায়ে সাদা ছোপ ছোপ দাগ, সঙ্গে ধারালো কাঁটা স্বাদুপানির মাছটিকে অন্য সব মাছ থেকে আলাদা করে তোলে। গবেষণায় দেখা গেছে, অত্যধিক দূষিত পানিতেও এ মাছ স্বাভাবিক জীবন যাপন ও বংশবিস্তার করতে পারে। এ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নদী-নালা, খাল-বিল—এমনকি পুকুরেও এ মাছের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে, যা অন্যান্য মাছের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং প্রজননে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও শ্রীলঙ্কায়ও সাকার মাছের বিস্তার সমস্যা সৃষ্টি করছে।

সাকার মাছ মোটেও আমাদের স্থানীয় নয়। এদের প্রাকৃতিক আবাস দক্ষিণ আমেরিকায়। ব্রাজিল, গায়ানা, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো দেশগুলোতে মাছটি সাধারণত পাওয়া যায়। তবে সারা পৃথিবীতেই শেওলা ও ময়লা থেকে অ্যাকুয়ারিয়াম পরিষ্কার রাখতে মাছটির ব্যবহার করা হয়। আশির দশকে বাংলাদেশেও সাকার আমদানি হয় কিছু মাছ ব্যবসায়ীর হাত ধরে। এর পর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে দেশের অনেক জলাশয়ে উন্মুক্ত করা হয়েছে এই মাছ। আর বাংলাদেশের অনুকূল আবহাওয়া মাছটির বংশবিস্তার করেছে ত্বরান্বিত।

আবর্জনাভূক এ মাছ প্রতিকূল পরিবেশেও বেশ ভালোভাবে বেঁচে থাকতে সক্ষম। ২৪ ঘণ্টা পানি ছাড়া থাকার পর আবার পানি পেলে এরা তরতাজা হয়ে উঠতে পারে। যার কারণে বুড়িগঙ্গার মতো দূষিত নদীতে যেখানে অন্যান্য মাছের বেঁচে থাকাই কষ্টকর, সেখানে সাকার মাছ অনায়াসে বংশবিস্তার করছে। সাম্প্রতিক সময়ে জেলেরা এর উৎপাতে অতিষ্ঠ। জাল ফেললেই সাকার মাছ উঠছে। বুড়িগঙ্গার পাশাপাশি অন্যান্য নদী-নালা—এমনকি কাপ্তাই লেকেও এ মাছ পাওয়া গেছে। দেশের প্রতিটি এলাকায় জেলেদের জালে এই মাছ আজকাল পাওয়া যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলাশয়ে দেশি মাছের প্রাকৃতিক খাবার শেওলা, ফাইটোপ্লাঙ্কটন, জুপ্লাঙ্কটন ইত্যাদি খাদ্য খেয়ে বেঁচে থাকে সাকার। ফলে এটি জলাশয়ে বেশি থাকলে প্রাকৃতিক খাদ্য দ্রুত কমে যাবে। এতে দেশি মাছের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। পাশাপাশি এরা অন্যান্য মাছের পোনা খেয়ে ফেলে, যার কারণে জলজ জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। আজকাল অনেকেই মাছটি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষেরা। কিন্তু মাছটির শরীরে রয়েছে উচ্চমাত্রায় বিষাক্ত রাসায়নিক ধাতু ক্যাডমিয়াম; যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এমনকি এ মাছ এতটাই বিষাক্ত যে এটিকে অন্যান্য মাছের খাদ্য কিংবা পোলট্রি ফিড তৈরিতেও কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।

সাকার মাছের এ দেশে অবাধ বিস্তারের পেছনে মানুষের ভূমিকাই প্রধান। পরিষ্কারের জন্য অনেকে একে অ্যাকুয়ারিয়ামে রাখলেও এরা অ্যাকুয়ারিয়ামের জৈবিক বর্জ্য আরও বাড়িয়ে দেয়। ফলে অনেকেই বাড়ির পার্শ্ববর্তী জলাশয়ে মাছটিকে অবমুক্ত করে দেয় এবং সেখানেই শুরু হয় এদের অবাধ বংশবিস্তার। জলাশয়ে থাকা বাকি সব মাছ, পোকামাকড়, ফাইটোপ্লাঙ্কটন এবং জুপ্লাঙ্কটনের ভারসাম্য নষ্ট করে এই মাছ। পাশাপাশি দেশের অনেক জলাশয় পানিদূষণের শিকার ও তার জলজ প্রাণীদের স্বাভাবিক জীবন আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত। এমন পরিস্থিতিতে সাকার সেসব প্রাণীর সার্বিক জীবন প্রজনন আরও কঠিন করে তোলে। বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মাছটি নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। বর্তমানে মাছটির আমদানি, বিক্রি, প্রজনন—এমনকি অ্যাকুয়ারিয়ামে পালনও সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এ প্রজ্ঞাপন ভূমিকা রাখলেও আমাদের সচেতনতা তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন। এখনো ঢাকা শহরের কাঁটাবনসহ বিভিন্ন শৌখিন মাছের দোকানে সাকার পাওয়া যায়। পাশাপাশি এখনো অনেকেই শখের অ্যাকুয়ারিয়ামে মাছটি রেখেছেন, যা অ্যাকুয়ারিয়ামের অন্য মাছের জন্যও ক্ষতিকর এবং জৈবিক বর্জ্যের পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে। নদীতে এ মাছের ব্যাপক বংশবৃদ্ধি রোধে বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণের ঘাটতি রয়েছে। অনেকেই না জেনে বিষাক্ত মাছটিকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ।

সাকার মাছের সমস্যা থেকে মুক্তির পথ প্রধানত দুটি। প্রথমত, এ বিষয়ে সরকারের প্রজ্ঞাপন যথাযথভাবে কার্যকর করতে হবে। এ মাছের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে নাগরিকদের সচেতন করতে হবে এবং এখনো যারা এই মাছের পালন প্রজনন ও বিপণনে যুক্ত, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এ মাছের দমনে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, যেমন জালে ওঠার পর অবমুক্ত না করে মাটিতে পুঁতে ফেলা। দ্বিতীয়ত, পানিদূষণ রোধ করতে হবে, তাহলে জলাশয়ের অন্যান্য মাছের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করা যাবে এবং দেশীয় মাছের প্রজনন বৃদ্ধি করে জলজ জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা যাবে। এ ক্ষেত্রে সব শ্রেণি-পেশার নাগরিকের সচেতনতা জরুরি।

*লেখক: ফাতিন ইশরাক সিয়াম খান, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি