বিশ্বকাপ মঞ্চে বাংলাদেশ, আমাদের প্রত্যাশা ও বাস্তবতা
দুয়ারে কড়া নাড়ছে ওয়ানডে বিশ্বকাপ, যেন ঘুম ভাঙলে বাজবে দামামা, শুরু হবে ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহারণ। ক্রিকেটকে ঘিরে বাংলাদেশের ভক্ত–সমর্থকদের মধ্যে যেন উন্মাদনার শেষ নেই, বস্তি থেকে পাঁচ তারকা হোটেলে, টঙের দোকান থেকে বড় বড় অট্টালিকা—সর্বত্রই যেন ক্রিকেটীয় আলাপচারিতায় সরগরম। গায়ের মোড়ে মোড়ে, শহরের অলিগলিতে চায়ের কাপে বিশ্বকাপ নিয়ে তর্কবিতর্কের ঝড় উঠেছে ইতিমধ্যে।
ক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি এবং দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারতের মাটিতেই বিশ্বকাপের পর্দা, প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় বিশ্বকাপের স্বাদ–ঘ্রাণ আমাদের একটু বেশি বিমোহিত করছে। ক্রীড়াপ্রেমীরা বিশ্বকাপের উন্মাদনায় এখন থেকেই বুঁদ হয়ে আছে। বিশ্বকাপের ক্ষণগণনা শুরু করে দিয়েছে বেশ আগে থেকেই। অপেক্ষার দীর্ঘ প্রহর অতিক্রম করার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছেন ভক্ত–সমর্থকেরা। ভাবনায় যখন ওয়ানডে বিশ্বকাপের মতো শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ের কথা, ঠিক তখনই মনের অজান্তেই ঈশান কোণে প্রশ্ন জমা হয় দলগত পারফরম্যান্স নিয়ে।
বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত খেলা ছয়টি বিশ্বকাপে (১৯৯৯-২০১৯) ৪২টি খেলায় অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে ১৪টি ম্যাচে আসে জয়ের বুনো উল্লাস, ২৬টি ম্যাচে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় এবং দুটি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছে। সর্বোচ্চ ইনিংস ৩৩৩/৮ (২০১৯) পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। সর্বনিম্ন ইনিংস ৫৮ (২০১১) ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রথম ছয়টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করেনি। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু বিশ্বকাপের সপ্তম আসরে ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে।
১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের অভিষেক বিশ্বকাপে শক্তিশালী পাকিস্তানকে হারিয়ে নিজেদের সক্ষমতা জানান দেন ক্রিকেট–বিশ্বকে, পুরো বিশ্বের সামনে মাথা উঁচু করে নিজেদের রাজকীয় আবির্ভাবের আগমনী বার্তা দিয়ে রাখে, জয়ের ধারা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অব্যাহত রাখে স্কটল্যান্ডের সঙ্গে। বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে ও লজ্জাজনক ঘটনার সাক্ষী হয় ২০০৩ সালে। পুঁচকে কানাডাসহ সব কটি ম্যাচ হেরে মাথা নিচু করে পরাজিত সৈনিকের মতো বিদায় নিতে হয় অশ্রু মুছতে মুছতে। নিজেদের দিনে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশ, সেটা জানান দেয় ২০০৭ বিশ্বকাপের আসরে। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে দুমড়েমুচড়ে দেওয়ায় বিজয়োল্লাসে মাতেন ভক্ত–সমর্থকেরা। বাংলাদেশের ঘরের মাঠে বসে বিশ্বকাপের আসর, তখন সালটা ২০১১। বিশ্বকাপকে ঘিরে বড় স্বপ্নের আশায় নেশাতুর হয়ে আছেন ভক্তকুল।
তিন জয়ের পরিপূর্ণ স্বাদ পেলেও বিষাদ নামায় দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৫৮ রান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৭৮ রানের অসহায় আত্মসমর্পণ করে বাংলাদেশ। প্রত্যাশার ছিটেফোঁটা দিয়েও রাঙাতে পারেনি ঘরের আসর, এমনকি গ্রুপ পর্বের দেয়াল টপকাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। ২০১৫ বিশ্বকাপ বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটি বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ডকে কাঁদিয়ে তিনটি জয় এক ড্র নিয়ে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে মুখ উজ্জ্বল করে, আর যা এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে বাংলাদেশের জন্য সর্বোচ্চ অর্জন। ২০১৯ সালে তিন জয় পেলেও মোটা দাগে আলোর মুখ দেখেনি বাংলাদেশ। তবে এ আসরে ক্রিকেটপাড়ায় রীতিমতো হইচই ফেলে দেয় বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে কোনো আসরে ৬০০ রান ও ১০ উইকেট নেওয়ার অবিনশ্বর রেকর্ড নিজের নামে পাকাপোক্ত করেন। সাকিব আল হাসানের পাশে অন্যদের দলগত পারফরম্যান্স থাকলে সেবার হয়তো ফলাফলটা ভিন্ন হতে পারত, মেতে ওঠা যেত দলগত সাফল্যের অনন্য বন্দনায়। গ্রুপ পর্বের বাধা টপকাতে পারলে হয়তো প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপ আসরের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে মনোনীত হতে পারতেন সাকিব আল হাসান। দেশের ক্রিকেটার থেকে শুরু করে ভক্ত-সমর্থক এবং শুভাকাঙ্ক্ষী ও বিশ্বাস করছে ২০২৩ সালটা বাংলাদেশ ইতিহাসের স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অনেক ভক্ত–সমর্থক দেখছেন শিরোপা উঁচিয়ে ধরার মতো বড় স্বপ্ন। কেউ কেউ দৃপ্ত কণ্ঠে বলছেন এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করছেন, প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে পদার্পণ করবে বাংলাদেশ। স্বপ্ন দেখার পেছনে যথেষ্ট কারণ লুকিয়ে আছে। ওয়ানডেতে বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছর ধরে অতিমানবীয় পারফরম্যান্স করছে। ওয়ানডেতে রীতিমতো ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে যেন, সিরিজের পর সিরিজে হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য।
ছুটেছে পাগলা ঘোড়ার বেগে, কখনো কখনো ছুটেছে স্টিমারের বেগে, তবে মোটেও হয়নি লাইনচ্যুত ট্রেনের মতো। টগবগিয়ে লাফিয়ে ওঠা যুবকের মতো অশনিসংকেত দেখানো, প্রতিপক্ষের ডেরায় থাবা মারা কিংবা কবর রচনা করা সক্ষমতার অমিয় কথা বলে। আইসিসি স্বীকৃত সুপার কাপে তৃতীয় স্থানে থেকে বিশ্বকাপ নিশ্চিত করা, টানা প্রায় ১৫ সিরিজ জয় বাংলাদেশের জন্য গৌরবগাথা অধ্যায়। শক্তিশালী আফ্রিকার মাটি থেকে সিরিজ সুনিশ্চিত করা বাংলাদেশ দলের শক্তিমত্তার অনন্য মাত্রা যোগ করে। তাই সেমিফাইনাল খেলার স্বপ্ন কিংবা বিশ্বকাপের ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখার অধরা স্বপ্ন ভক্তদের মনে বাসা বেঁধেছে।
স্বপ্নপূরণের জন্য অবশ্যই থাকতে হবে সুনির্দিষ্ট গন্তব্য। লক্ষ্যটা স্বপ্নের মধ্যে নির্ধারণ করা উচিত, যেন স্বপ্নপূরণের তাড়না লক্ষ্যের কাছে পৌঁছে দেয়। গন্তব্য ছাড়া কখনোই সফলতার সোপানে আরোহণ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের লক্ষ্য ও স্বপ্ন একসূত্রে গাঁথা। লক্ষ্যের দিকে মৃদু মৃদু পায়ে হেঁটে যেতে যেতে যেন দেখা হয় স্বপ্নের, উঁচিয়ে ধরা যায় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট।
তবে বাস্তবতা অনেকটা ভিন্ন, সেমিফাইনালে উত্তরণের পথ মোটেও সহজ নয়, বরং দুর্ভেদ্য। পথে পথে সারি সারি কাঁটা বিছানো সব বাধা উপড়ে ফেলে তবেই ছুঁতে হবে স্বপ্নকে। বিগত বছরের সমীকরণ অনুযায়ী বলা যায়, ৯টি ম্যাচের ৬টিতে জয় নিশ্চিত করতে পারলে বাধাহীনভাবে যেতে পারবে সেমিফাইনালে। কিন্তু কাজটা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের। কারণ, সেই পথে বাধা হবে শক্তিশালী দলগুলো, যাদের বিরুদ্ধে হেড টু হেড খুব সুবিধাজনক নয়। এ ছাড়া মাইন্ড গেমে বাংলাদেশ অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। বাংলাদেশ সেমিফাইনালে যেতে হলে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো যেকোনো চারটা শক্তিশালী দলকে পেছনে ফেলে নিজেদের জায়গা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যান্য যেকোনো আসরের চেয়ে এ বছরের বিশ্বকাপ দলটা বেশ গোছানো। তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার এক দারুণ মেলবন্ধন স্পষ্ট। তরুণ ও অভিজ্ঞদের মধ্যে সৃষ্ট দারুণ রসায়নে দলগত সাফল্যের পথ সুগম হতে পারে। প্রতিটি পজিশনেই তারা নিজেদের প্রমাণ করে বিশ্বকাপ দলের টিকিট পেয়েছে। আক্ষেপ কিংবা বিতর্কের জায়গা হয়তোবা দেশসেরা ওপেনার তামিম ইকবালকে নিয়ে।
তামিম ইকবালের মতো অভিজ্ঞ একজন ওপেনার দলের জন্য অনেক বেশি কার্যকর, কিন্তু না থাকাটা দলের জন্য একটা ধাক্কাও বটে। তবে তামিমের বিশ্বকাপ পরিসংখ্যান মোটেও তামিমসুলভ নয়। এ জায়গায় আশার আলো দেখাতে পারেন তানজিদ তামিম, তাঁর দারুণ একাগ্রতা ও ক্ষিপ্রতা রয়েছে। টপ অর্ডারে আরেক পরীক্ষিত সৈনিক নাজমুল হোসেন শান্ত দলের অন্যতম আস্থার প্রতীক। মিডল অর্ডারে তাওহীদ হৃদয়, মুশফিকুর রহিমের মতো চৌকস খেলোয়াড় দলে আছেন। আছেন সাকিব আল হাসান ও মেহেদী হাসান মিরাজের মতো কমপ্লিট প্যাকেজ। ফিনিশিংয়ে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ হয়ে উঠতে পারেন দুর্দান্ত। প্রতিপক্ষকে ধস নামানোর জন্য বাংলাদেশের স্পিন যথেষ্ট কার্যকর, বর্তমান পেস অ্যাটাক ইতিহাসের অন্যতম সেরা পেস অ্যাটাক। ডেথ ওভারে মোস্তাফিজুর রহমান, নতুন বলে তাসকিন-হাসান মাহমুদরা হয়ে উঠতে পারে বিধ্বংসী। তবে আত্মবিশ্বাসের ভাটা পড়তে পারে ইংল্যান্ড ও আফগানিস্তান সিরিজের নেতিবাচক ফলাফল। সর্বশেষ এশিয়া কাপেও খুব সুখকর ফল নিয়ে দেশে ফিরতে পারেনি বাংলাদেশ। অবশ্য দলটা তখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জাঁতাকলে পিষ্ট ছিল। সেই জায়গা থেকে বের হয়ে এখন একটা শক্তিশালী কার্যকর একাদশ গঠনের মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে কার্যকর হবে মাইন্ড গেমে এগিয়ে থাকা।
কারও চোখরাঙানিকে না ভয় পেয়ে উল্টো চোখরাঙানি দেখানো। প্রতিপক্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের আত্মবিশ্বাসের ফোয়ারা দেখানো, প্রতিপক্ষ বিবেচনায় হারার আগে হেরে না যাওয়া এবং শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়া ইতিবাচক ফল নির্ধারণে সহায়ক হতে পারে। সব গ্লানি মুছে দলগতভাবে পারফরম্যান্স করুক, বুক চিতিয়ে লড়ে দেশের পতাকাকে উঁচিয়ে ধরে সাফল্যের চূড়ায় অধিষ্ঠিত হোক বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা বিশ্বকাপ হোক এটা এবং দুয়ারে কড়া নাড়ুক সর্বোচ্চ সাফল্য।
লেখক: জুবায়েদ মোস্তফা, শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ