ইয়া আলির জুবিন গার্গ শিল্পের নিপুণ সাধক!
২০০৬ সালে মুক্তি পাওয়া মুম্বাইয়ের গ্যাংস্টার সিনেমার প্রার্থনাধর্মী প্রেমের গান ‘ইয়া আলি, রেহেম আলি /ইয়া আলি, ইয়ার পে কুরবান হ্যায় সবি /ইয়া আলি, মদদওয়ালি /ইয়া আলি, ইয়ে মেরি জান ইয়ে জিন্দেগি ইশক পে হ্যায় (হে আলি, দয়া করো আলি /সবাই আলির (প্রিয় বন্ধুর) জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত /হে আলি, সাহায্যকারী আলি /হে আলি, এই আমার প্রাণ, এই আমার জীবন ভালোবাসার পথে।
পুরো গানেই মূলত একতরফা প্রেমিকের বেদনা ও প্রার্থনার সুর আছে। প্রেমে যে কষ্ট, বিশ্বাসঘাতকতা আর একাকিত্ব এসেছে, সবই আলির কাছে সমর্পণ করছে। প্রেমকে সে একধরনের আধ্যাত্মিক ভক্তি হিসেবে দেখাচ্ছে।
কথাগুলো জুবিনের কণ্ঠে গিয়েছিল বলেই হয়তো এর আলাদা দ্যোতনা সৃষ্টি হয়েছিল। এখনো যা সমান আবেদনময়ী।
প্রকৃতিপ্রদত্ত জাত শিল্পী একজন জুবিন গার্গকে নিয়ে গণমানুষের যে আবেগ দেখলাম, তা সচরাচর চোখে পড়ে না। জুবিন ঘোষণা দিয়ে কাঠামোবদ্ধ জাতি ও ধর্মের বাইরে থেকে মানবতার জন্য কাজ করে গেছেন। মিস্টার গার্গের জন্য মানুষের ইমোশনের যে উত্তুঙ্গ পারদ দেখলাম, তাতে আবার প্রমাণ হলো ঐন্দ্রজালিক এক শক্তি আছে কেবল শিল্পেরই। শিল্পের সেই ধর্মের নাম হলো sublimity, যা মহিমা, মহত্ত্ব, উৎকর্ষ, মহিমান্বিত গুণ, শ্রেষ্ঠত্ব বা রৌদ্রোজ্জ্বল মহৎ সৌন্দর্য ব্যতিরেকে অন্যবিধ আর কিছুই নির্দেশ করে না।
তিন দশকের বেশি সময় ধরে ৪০টি ভাষা ও উপভাষায় ৩৮ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন জুবিন গার্গ। শুধু একজন গায়ক নন, তিনি হয়ে উঠেছিলেন আসামের সাংস্কৃতিক অহংকার, যিনি নিজের প্রান্তিক রাজ্যকে পৌঁছে দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে। তথাকথিত স্টারডম এই শিল্পীকে স্পর্শ করেনি। মুম্বাইয়ের ঝাঁ–চকচকে জীবনকে পায়ে দলে আসামের গ্রামকে তিনি স্বর্গ বানিয়ে নিয়েছিলেন। নিজের আপনভূমিতে তিনি রাজা হয়ে উঠেছিলেন।
এনডিটিভি লিখেছে, জুবিন গার্গ শুধু গান গাওয়া কণ্ঠস্বর ছিলেন না, তিনি এক প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সঙ্গী ছিলেন। তাঁর চলে যাওয়া তাই শুধু শোক নয়, এক শহরের স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার মতো গভীর এক ব্যথা, যা চাইলেও ভুলে থাকা যায় না।
গত মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জুবিনের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। হাজারো ভক্ত উপস্থিত ছিলেন শেষবিদায় জানাতে। এর আগে গুয়াহাটির ভোগেশ্বর বড়ুয়া স্পোর্টস কমপ্লেক্সে ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ীদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য রাখা হয়েছিল তাঁর মরদেহ। বিপুল ভিড় সামলাতে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, স্টেডিয়াম সারা রাত খোলা থাকবে।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আসামের অন্যতম জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক আইকন ছিলেন জুবিন গার্গ। অসমিয়া, বাংলা ও হিন্দি গানে তিনি সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন। তিনি ভারতজুড়ে পরিচিতি পান ‘গ্যাংস্টার’ সিনেমার গান ইয়া আলির মাধ্যমে। পরে ‘কৃষ ৩’-এর ‘দিল তু হি বাত’সহ বহু জনপ্রিয় গান উপহার দেন।
প্রায় দুই দশক পর, হঠাৎ মৃত্যু যেন ‘অবশ’ করে দিল আসামকে। প্রিয় শিল্পীকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেল গুয়াহাটি শহর। দোকানপাট বন্ধ, সেবা কার্যত অচল। যেন কোনো শিল্পীকে নয়, নিজেদেরই এক টুকরা সত্তাকে হারাল আসামবাসী।
গুয়াহাটির লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদলই বিমানবন্দর থেকে কাহিলিপাড়া পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পথজুড়ে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলেন শিল্পীকে শেষবার দেখতে। আগের রাতেই সিঙ্গাপুর থেকে পৌঁছায় তাঁর মরদেহ। সাঁতার কাটতে গিয়ে খিঁচুনির কারণে পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় তাঁর।
ফুলে সাজানো অ্যাম্বুলেন্স যখন ধীরে ধীরে শহরে ঢুকল, সাধারণত আধা ঘণ্টার পথ পেরোতে লেগে গেল পাঁচ ঘণ্টার বেশি। কারণ, রাস্তার দুই পাশে ভিড় করেছিল হাজারো মানুষ। প্রবীণ, নারী, শিশু, তরুণ-তরুণী, প্রতিবন্ধী—সবার হাতে ফুল, চোখে জল, ঠোঁটে প্রার্থনা। অনেকে শুধু নাম ধরে ডাকছিলেন ‘জুবিনদা…।’
গণমাধ্যমগুলো বলছে, শুধু রাস্তা নয়, গুয়াহাটি শহর যেন কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। বাজার, হোটেল, রেস্তোরাঁ—এমনকি খাবার ডেলিভারি সার্ভিসও বন্ধ থাকে। অনেকেই একে ‘ব্ল্যাক ডে’ বলছেন।
ভারতীয় গায়ক জুবিন গার্গ মারা গেছেন ১৯ সেপ্টেম্বর। মৃত্যুর পরই লেখক-ঔপন্যাসিক রীতা চৌধুরীর সঙ্গে করা জুবিনের শেষ পডকাস্ট ভাইরাল হয়। সেখানেই নিজের মৃত্যুতে আসামের মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, তা আগেই বলেছিলেন তিনি। ভবিষ্যদ্বাণী করে জুবিন বলেছিলেন, ‘আমি যদি আসামে মারা যাই, আসাম সাত দিন থমকে যাবে।’ শেষযাত্রায় আসাম থেকে সে ভালোবাসাই যেন পেলেন জুবিন। তাঁর মৃত্যুতে সত্যিকার অর্থেই সবকিছুই থমকে গিয়েছিল।
মুম্বাইয়ে কাটানো বছরগুলোর স্মৃতি টেনে পডকাস্টে জুবিন বলেন, ‘আমি ১২ বছর মুম্বাইয়ে ছিলাম, শহুরে জীবন আমাকে বিরক্ত করে তুলেছিল। অনেকে জিজ্ঞাসা করে, কেন মুম্বাইয়ে থাকি না? আমি বলেছি, রাজা কখনো নিজের রাজ্য ছেড়ে যায় না। ওখানে কোনো রাজা নেই। লতা মঙ্গেশকর মারা গেলেন, কিছু হলো? না। রাজেশ খান্না মারা গেলেন, শুধু খবর হলো রাজেশ খান্না মারা গেছেন। কিন্তু আমি যদি আসামে মারা যাই, আসাম সাত দিন থমকে যাবে।’
শিল্পের কী অসীম শক্তি। একজন প্রচলিত ধর্মের অনুবর্তী না থাকা মানুষের জন্য সর্বধর্মের মানুষ একযোগে প্রার্থনায় শামিল হলেন। জুবিনের ধর্ম ছিল নিখাদ সংগীত। যে সংগীতে মানুষের কথাই সুর হয়ে বাজত। ঠিক যেন ঘরের জানালায় রোজকার প্রভাতপাখির আনন্দ গান।
তাঁর অনুরাগীরা, বিশেষ করে আসামবাসী ও উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষ, শিল্পীর বিচ্ছেদে একধরনের সাংঘাতিক শূন্যতা অনুভব করেন, কারণ তাঁরা মনে করেন, তাঁদের একজন প্রতিনিধি গায়কের চলে যাওয়া—যিনি তাঁদের ভাষা, অনুভূতি, স্বপ্ন, সংগ্রাম ও সাংস্কৃতিক চেতনা প্রকাশ করতেন।
অনেকেই মনে করেন, জুবিন গার্গ শুধুই ‘গায়ক’ ছিলেন না, তিনি একটি প্রতীক, একটি আবেগ, একটি সাংস্কৃতিক শক্তি। তাই ব্যক্তি মারা গেলেও তাঁর ‘কণ্ঠ’ ও ‘অনুভূতি’ মানুষের মধ্যেই বেঁচে থাকবে।
এ ধরনের জনপ্রিয় শিল্পীর হঠাৎ অকালমৃত্যু সাধারণ মানুষের হৃদয়ে বড় এক ফাঁক তৈরি করে, যা গণশোকের আকার পায়। জুবিন গার্গের ক্ষেত্রে আমরা ঠিক তাই–ই দেখলাম।
বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান সংকোচনে হতবিহ্বল হচ্ছে শিল্পচর্চার পথ। না শহরে, না গ্রামে এখানকার শিল্পীরা কোথাও এতটুকু নিরাপদ বোধ করছেন না। শিল্পীরাও প্রায় জবান বন্ধ করে বসে আছেন। শিল্পী জুবিন গার্গের প্রতি সর্বমানুষের অতুল সম্মানও আমাদেরকে কিছুই শেখাতে পারবে না হয়তো। কারণ, বঙ্গজ সমাজ এখন মধ্যপ্রাচ্যের একপেশে সংস্কৃতিতে বিভোর। এখানকার শিল্পের মঞ্চ তাই প্রায় জনশূন্য।
অথচ শিল্প হলো মানুষের অন্তর্নিহিত অনুভূতি, চিন্তা ও কল্পনার বহিঃপ্রকাশ। চিত্রকলা, কবিতা, নাটক বা সংগীত মানুষের ভালোবাসা, বেদনা, আকাঙ্ক্ষা বা প্রতিবাদের জোরালো ভাষা হয়ে ওঠে। শিল্প মানুষকে ভাবতে শেখায়, প্রশ্ন করতে শেখায়, সীমাবদ্ধতার বাইরে দেখায়। এটি আমাদের মানসিক দিগন্ত প্রসারিত করে এবং জ্ঞান ও উপলব্ধিকে সমৃদ্ধ করে। সংগীত ও শিল্পের নিপুণ সাধক জুবিন গার্গ আমাদেরকে সেটিই প্রমাণ করে দেখিয়ে চিরায়ত উদাহরণ হয়ে রইলেন। মহাকাল এই উদাহরণকে স্মরণ করে যাবে গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়।