একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থীর বয়ান
কখনো কখনো ভাবি, বোর্ড পরীক্ষার ব্যাচ হিসেবে আমরা অভিশপ্ত কি না। শুরুটা হয়েছে ২০১৯ সালের জেএসসি থেকে। স্কুলে ফাইনাল পরীক্ষা শেষে সরকার থেকে ঘোষণা আসে পুনর্বিন্যাসকৃত সিলেবাসে জেএসসি পরীক্ষা হবে। ইংরেজি ও বাংলার প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র এক করে ফেলা হলো। এই পুনর্বিন্যাসকৃত সিলেবাসের সঙ্গে যেখানে এখনো খাপ খাইয়ে নিতে পারিনি, সেখানে ঘোষণা আসার এক মাসের মধ্যে পরীক্ষায় বসতে হলো।
গণিত পরীক্ষার আগে আবার আরেক বিপত্তি। ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’-এর জন্য পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হলো। অনেক এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলো। দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জেএসসি পরীক্ষার্থী সেবার বাকি পরীক্ষাগুলো দিতে পারল না। তারপর পরের বছর মহামারি ‘কোভিড-১৯’ ছড়িয়ে পড়ল। টানা প্রায় দুই বছর স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকল। পরিশেষে ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কোভিড প্রোটোকল আরোপ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলো। আমাদের সবার মাস্ক পরে স্কুলে প্রবেশ করা বাধ্যতামূলক। মাস্ক একদিন ভুলে রেখে এসেছিলাম, স্কুলে আর ঢুকতেই দেয়নি। তারপর পাঁচ টাকা দামের মাস্ক কিনে স্কুলে প্রবেশ করলাম।
টানা প্রায় দুই বছর আমরা কেউ ভালোভাবে পড়াশোনা করিনি। ক্লাসে যে কয়েকটা ক্লাস টেস্ট নিয়েছিল, আমরা সবাই গণহারে অকৃতকার্য হয়েছিলাম। আমাদের অবস্থা দেখে কর্তৃপক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত এল, এ বছর বার্ষিক পরীক্ষা শুধু ইংরেজি, বাংলা ও গণিতের ওপর হবে। আমার দুর্বলতা ছিল সায়েন্সের বিষয়গুলোয়, তাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কোনোমতে ভালো একটি পজিশনে রেজাল্ট করে ক্লাস ১০ পার করলাম।
পরের বছর এসএসসি। স্কুল কর্তৃপক্ষ একটি মডেল টেস্ট নিয়ে দেখল, আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ। ওরা সিদ্ধান্ত নিল, আরেকটি মডেল টেস্ট নেবে। এর মধ্যে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এসএসসি হবে। ৩০টি এমসিকিউয়ের মধ্যে মাত্র ১৫টি দাগাতে হবে আর ৮টি সৃজনশীলের মধ্যে মাত্র ৩টি দাগাতে হবে। আমাদের খুশি আর দেখে কে! এসএসসি পরীক্ষা শুরু হতেই আবার স্থগিত। ঘূর্ণিঝড় ফণী দেশে হানা দিয়েছে। উত্তরাঞ্চলের কিছু শিক্ষার্থী আবার নিঃস্ব হয়ে গেল, সে বছর ওরা আর পরীক্ষা দিতে পারল না। পরীক্ষা শুরু হতেই দিনাজপুর বোর্ডের প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে একটি বিতর্ক সৃষ্টি হলো এবং তাদের বোর্ডের পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হলো। পরীক্ষার সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে আর মার্ক ডিস্ট্রিবিউশন এত সহজ হওয়ার জন্য সেবার আমার স্কুল শতাধিক জিপিএ-৫ পাওয়ার মাইলফলক অর্জন করেছিল।
আমি রাজশাহী থেকে চলে এলাম আর ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে ভর্তি হলাম।
দুই বছর ভালোমতো পড়াশোনা না করার জন্য এইচএসসি সিলেবাসের ব্যাপকতা দেখে ভালোই ঝামেলায় পড়লাম। বেশির ভাগ চ্যাপ্টারের পূর্ব কনসেপ্ট একদমই নেই। তার মধ্যে এত কম সময়ে এত বড় সিলেবাস শেষ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। অর্ধবার্ষিকে আমার ক্লাসের ৯০ শতাংশ ছাত্র কোনো না কোনো বিষয়ে অকৃতকার্য হলো। আমি জীবনেও কোনো বিষয়ে ফেল করিনি। জীবনে প্রথমবার অকৃতকার্য হলাম দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। সারা দিন খালি পড়তাম। বাসার কাছে ১০ থেকে ২০টা কোচিংয়ে পড়া শুরু করলাম আর খুব শিগগিরই আমি আমার বেসিক কনসেপ্টটা ক্লিয়ার করলাম। টেস্ট পরীক্ষা পাস করে একটি কোচিং সেন্টারে মডেল টেস্ট কোর্সে ভর্তি হয়ে চূড়ান্ত প্রিপারেশন নিয়ে বসে ছিলাম এইচএসসির জন্য।
এইচএসসি পরীক্ষার ঠিক আগে আগে টানা বৃষ্টির জন্য সিলেটের কিছু অঞ্চল বন্যায় ভেসে গেল।
ঘরবাড়ি ডুবে গিয়ে পরীক্ষার্থীরা বিপাকে পড়ল। তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সিলেট বোর্ডের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। অন্যান্য বোর্ডের পরীক্ষার্থীরা তখন টুকটাক আন্দোলন করে তাদের পরীক্ষা পেছানোর জন্য। এর মধ্যে সিলেট বোর্ডের অনেক পরীক্ষার্থী বন্যায় সর্বস্ব হারিয়েছে। তাদের আর এ বছর পরীক্ষা দেওয়া হলো না।
অন্যান্য বোর্ডের পরীক্ষার্থীরা বর্ষাকালের ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পরীক্ষায় বসল। কিছুদিন না যেতেই দেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলো। এর পরিপ্রেক্ষিতে আবার স্থগিত করা হলো আমাদের পরীক্ষা। দেশের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকে। একপর্যায়ে সব পরীক্ষা পিছিয়ে দিয়ে ১১ আগস্ট নতুন সময়সূচি ঘোষণা করে সরকার।
সেই শুরু থেকে আমাদের ব্যাচ এভাবে একের পর এক দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। প্রত্যেক বোর্ড পরীক্ষায় আমরা কোনো না কোনো পরিস্থিতির শিকার হচ্ছি। এর জন্য আমার কখনো কখনো ইচ্ছা হয়, মেয়র সাঈদ খোকনের মতো মনের আক্ষেপে বলি, ‘আর মানুষ পান নাই? বারবার শুধু আমাদের ওপরই! কেন?’
*লেখক: মাহিন ইকবাল কাজী, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ, ধানমন্ডি, ঢাকা