চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন শিল্প: জাতীয় গৌরব এবং ঐতিহ্যের স্মারক

আমফাইল ছবি

চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাংলাদেশের সর্বপশ্চিমের সীমান্তবর্তী জেলা। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন শিল্প অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আমের রাজধানী হিসেবে সুপরিচিত হলেও অনেক শিল্প রয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। জেলার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও মাইলফলক বললেও ভুল হবে না। বিশেষ করে লাক্ষাশিল্প, মৃৎশিল্প, কাঁসা-পিতলশিল্প, বাঁশ-বেতশিল্প, রেশমশিল্প প্রধান। এ ছাড়া নকশিকাঁথা, মাটির ফলকচিত্র, আলপনা, প্রভৃতি আমাদের লোক ও কারুশিল্পের নিদর্শন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৬৩০০ রকমের কুটিরশিল্প রয়েছে। এসব কুটিরশিল্পের অধিকাংশ বিলুপ্ত। যেসব শিল্প টিকে আছে, সেগুলো থেকে মূল কয়েকটি সম্পর্কে তুলে ধরা হলো।

আমশিল্প

বাংলাদেশের সিংহ ভাগ আমই উৎপাদন হয় এ জেলায়। এ জেলার আমের কদর শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আমের জুস করছে। এতে অনেক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু যুগ যুগ ধরে আমাদের মা-বোনেরা আম থেকে আমের রস, আমের মোরব্বা, আমের স্কোয়াশ, আমের জেলি, আমের পাল্প, আমের টফি, আমের মধু, আমস্বত্ত্ব, আমের বরফি, আমের আচার ও আমচুর তৈরি করেন। এসব দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে বাড়তি আয় হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ‘আম গবেষণা কেন্দ্র’ রয়েছে। আমশিল্পের ব্যাপারে তাঁদের তেমন গবেষণা নেই বললেই চলে। সে জন্য আমিশিল্পের ব্যাপারে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ সরকারি ও বেসরকারিভাবে। কারণ, বাংলাদেশে আমজাত পণ্যের চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ম্যাঙ্গো জুস এখন কোমল পানির চাইতে অনেক বেশি জনপ্রিয়।

তাঁতশিল্প

চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার চার শতাধিক ব্যক্তি তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের বহরম তাঁতিপাড়া ও লাহারপুর তাঁতিপাড়ায় হাতে চালিত তাঁতের মাধ্যমে কাপড় তৈরি করা হয়। শিবগঞ্জ উপজেলার বিশ্বনাথ তাঁতিপাড়া ও হরিনগরে মেশিনচালিত তাঁত রয়েছে। প্রায় আট শ কারিগর তথা শ্রমিক কাজ করছে। তাঁদের মধ্যে নারীসহ আদিবাসী মেয়েরাও কাজ করছেন। কিছু তরুণী রাজশাহী কলেজে পড়াশোনা করছেন। পাশাপাশি এ শিল্পে কাজ করছেন।

দৈনিক চার হাজার গজ কাপড় তৈরি হয়। সিংহভাগের ক্রেতা ঢাকার একটি বড় ফ্যাশন ও লাইফ স্টাইল ব্র্যান্ড। এতে নতুনভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। তাঁতশিল্পমালিক শ্রী শুভময় দাস বলেন, হরিনগরে রয়েছে মেশিনচালিত তাঁতশিল্প। রাজশাহীকে চিনে তাঁতশিল্প হিসেবে। কিন্তু মূল তাঁতশিল্প তৈরি হয় হরিনগরে। হরিনগরে তাঁতির উৎপাদিত কাপড় চলে যায় আড়ং সোসাইটির কাছে। অনলাইনেও ব্যবসা করছেন অনেকেই।

লাক্ষাশিল্প

লাক্ষা একধরনের অতি ক্ষুদ্র পোকা, ক্যারিয়া ল্যাক্কা নিঃসৃত রজনজাতীয় পদার্থ। দেখতে অনেকটা উকুনের মতো। এটা প্রাণিজাত বহুমুখী একধরনের রজন। এ পোকার ত্বকের নিচে থাকে একধরনের গ্রন্থি, যা থেকে নিঃসৃত হয় একধরনের আঠালো রস, যা ক্রমেই শক্ত ও পুরু হয়ে পোষক গাছের ডালকে আচ্ছাদিত করে। এ আবরণকেই ‘লাক্ষা’ বলে। তবে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষের কাছে এটি ‘লাহা’ হিসেবে পরিচিত।

বাংলাদেশের মাত্র ১২ হাজার হেক্টর এলাকায় এখন লাক্ষার চাষ হচ্ছে। উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১ হাজার মেট্রিক টনের মতো। অথচ দেশে এর বার্ষিক চাহিদা ২০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি। চাঁপাইনবাবগঞ্জে বর্তমানে লাক্ষার যে পোষক রয়েছে, সেখান থেকে বছরে প্রায় ৫০০ টন‌ লাক্ষা উৎপাদন সম্ভব, যার বর্তমান বাজারমূল্য ৪০ কোটি টাকার বেশি। এর মাধ্যমে প্রায় ২০ হাজার ভূমিহীন প্রান্তিক কৃষকের কর্মসংস্থান করাও সম্ভব।

লাক্ষার উপাদান কাঠের আসবাবপত্র বার্নিশ করা, বিভিন্ন ধরনের বার্নিশ পেইন্ট, পারফিউম, অস্ত্র কারখানা, রেলওয়ে কারখানা, লবণাক্ত পানি থেকে জাহাজের তলদেশ রক্ষার কাজে বার্নিশ, ওষুধ, স্বর্ণালংকারের ফাঁপা অংশ পূরণ, চামড়া ও বৈদ্যুতিক শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া ডাকঘরের চিঠি, পারসেল সিলমোহর, পুতুল, খেলনা, আলতা, নখরঞ্জন, শুকনা মাউন্টিং টিস্যু পেপার ইত্যাদি তৈরির কাজেও লাক্ষা ব্যবহৃত হয়। ইদানীং এর উপাদান চকলেট, চুইংগাম ও লেবুজাতীয় ফলের সংরক্ষণ ও এর গুণ বৃদ্ধির জন্য কোটিন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে রয়েছে লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্র। তবে কার্যক্রম চোখে পড়ার মতো নয়।

মৃৎশিল্প

মৃৎশিল্পের ইতিহাস ও ঐতিহ্য হাজার বছরের। এ শিল্পকে ঘিরে গ্রামবাংলার অনেক পরিবার জীবন-জীবিকাও নির্বাহ করেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার বারোঘরিয়া কুমারপাড়া, নতুন বাজার, চুনারিপাড়া ও রাজারামপুর কুমারপাড়ার প্রায় তিন শ পরিবার এ পেশার সঙ্গে জড়িত। এছাড়াও গোমস্তাপুর ও শিবগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এখনো কুমার পরিবার রয়েছে।

তাঁদের তৈরি মাটির জিনিসপত্রের মধ্যে হাঁড়ি, হাঁড়ির ঢাকনা (সরা), মালসা, কলস, নান্দা, হাড়া (কোলা), শানকি (বাসন), দইয়ের পাত্র, ধুনছি, মাটির ব্যাংক, বাচ্চাদের খেলনা (পুতুল-ঘোড়া), মাটির ভাঁড়, টয়লেটের পাট, মটকার টালি ইত্যাদি। এসব মাটির তৈরি জিনিসপত্র বাড়ি বাড়ি ফেরি করে স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি করে থাকে ফেরিওয়ালারা।

কাঁসা–পিতলশিল্প

কাঁসা-পিতলজাতশিল্প এ দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ শিল্পের বয়স ৩০০-৪০০ বছর অতিক্রম করেছে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। কাঁসা ও পিতলের ব্যবহার জনপ্রিয়তা অর্জন করে মোঘল আমলে। এসব ধাতু দিয়ে তখন ঢাল, তলোয়ার, তির-ধনুক, বন্দুক, কামান পর্যন্ত তৈরি করা হতো। এরপর  কাঁসা ও পিতল দিয়ে বিভিন্ন দৈনন্দিন নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরির কাজ শুরু হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পারিবারিক শিল্প হিসেবে বংশ পরম্পরায় তৈরি হয়ে আসছে বিভিন্ন তৈজসপত্র। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার আজাইপুর, আরামবাগ, রামকৃষ্টপুর, বটতলাহাট ও শংকরবাটি এলাকায় কাঁসা, পিতল ও তামার তৈজসপত্র তৈরি হয়। একসময় প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এসব তৈরি করা হতো। এমনকি কাঁসাড়িপাড়া নামে একটি গ্রামের নামকরণ করা হয়। ফলে ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ আগে কাঁসা-পিতলশিল্পের সঙ্গে  যুক্ত থাকলেও এখন তা কমে প্রায় দুই শ হয়েছে। কাঁসার থালা, বাটি, কলস, জগ, গামলা, বদনা, বালতি ,বাউলি, ছেচকি কড়াইসহ বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরি করা হয়।

বাঁশ ও বেতশিল্প

চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাঁশ ও বেতশিল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়নে। গ্রামীণ উৎসব ও মেলাগুলোতে বাঁশ ও বেতের তৈরি খোল, চাটাই, চ্যাঙারি, কুলা, ডালা, পাখা, ধামা, ডালি, কাঠা, হাইট্যা, টোনা, মোড়া, দোলনা, বুক শেলফ, মাছ ধরার চাঁই বিক্রি হতো। তবে যতই দিন যাচ্ছে, ততই কমে যাচ্ছে বাঁশ ও বেতশিল্পের কদর। রামচন্দ্রপুর হাট, বটতলা হাট, শিবগঞ্জ, রানীহাটি, কানসাট, সত্রাজিতপুর বাজার, রাজবাড়ি হাটসহ গ্রাম-গঞ্জে পাওয়া যায়। কিছু শৌখিন মানুষ এসব পণ্য আজও কিনে। এখনো অনেক মানুষ এ পেশায় নিয়োজিত।

রেশমশিল্প

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার রেশমশিল্পের ইতিহাস বহু পুরনো। ভোলাহাটের রেশমচাষিরা বাংলাদেশের রেশমের শতকরা ৭৫ ভাগ উৎপাদন ও সরবরাহ করে থাকে। পাল রাজাদের শাসনামলের পর সেন রাজাদের শাসনামলে ভোলাহাটে রেশম শিল্পের জয়জয়কার ছিল। ১৯৬১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ভোলাহাট, গোমস্তাপুর, নাচোল ও শিবগঞ্জ এলাকা নিয়ে গঠন করা হয় জেলা রেশম সম্প্রসারণ কার্যালয়।

যুগ যুগ ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অধিকাংশ গ্রামের নারীরা ঘরে ঘরে পলু চাষ করে রেশম গুঁটি তৈরি করতেন। যেখানে সেখানে তুঁতগাছ চোখে পড়ত। হাজারো নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান বা জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা বিদ্যমান ছিল। এখনো টিকে আছে এই ঐতিহ্য।

নকশিকাঁথাশিল্প

নকশিকাঁথা চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যতম ঐতিহ্য বলা যেতে পারে। বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ নকশি কাঁথার জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। হাজারো গ্রামীণ নারী নকশিকাঁথা তৈরির কাজ করছেন। নকশিকাঁথার চাহিদা বেড়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে তৈরি নকশিকাঁথা দেশের সীমা পেরিয়ে আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাদৃত হচ্ছে। শৌখিন পণ্য হিসেবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তৈরি হচ্ছে নকশিকাঁথা। একসময় পুরাতন কাপড় ব্যবহার করত। এখন ব্যবহার হচ্ছে নতুন মার্কিন, লালসালু কিংবা কালো কাপড় এবং বিদেশি সিল্কি পেটি সুতা। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩০০টির মতো কারখানায় প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক কাজ করে। যার মধ্যে ৯৫ শতাংশই নারী শ্রমিক হিসাবে কাজ করছে। এসব নারী শ্রমিক গৃহকাজসম্পন্ন করে অবসরে নকশিকাঁথা করেন। এ খাতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় চার লাখ লোক জড়িত।

শেষে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শিল্প টিকিয়ে রাখতে বর্তমান সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

  • লেখক: শিক্ষক, হরিমোহন সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ