বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটার কার স্বার্থে
সাধারণ গ্রাহকদের আপত্তি সত্ত্বেও বিদ্যুৎ বিভাগ সারা দেশের বাসাবাড়ি, অফিস–আদালত ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে প্রিপেইড মিটার স্থাপন অব্যাহত রেখেছে। প্রতিদিনই প্রিপেইড মিটার সম্পর্কে গ্রাহকদের অসন্তোষ ও বিক্ষোভের খবর গণমাধ্যমে এলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।
বিদ্যুৎ বিভাগের ভাষ্যমতে বিদ্যুৎ খাতে চুরি, অপচয়, ওভারলোড ও বকেয়া বিল ঠেকাতে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের ব্যর্থতার দায় গ্রাহকদের কাঁধে চাপিয়ে প্রকারান্তরে জনগণের পকেট লুণ্ঠন ও চরম ভোগান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। সারা দেশে একযোগে পিডিবি, আরইবি, নেসকো, ডিপিডিসি, ডেসকো, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন এই প্রিপেইড মিটার স্থাপনের কাজ করছে।
এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের আগে বিদ্যুৎ বিভাগের গ্রাহকদের মতামত গ্রহণ কিংবা একটি গণশুনানির আয়োজন করা উচিত ছিল। কিন্তু জনমতের তোয়াক্কা না করে একতরফাভাবে বিদ্যুৎ বিভাগ তাদের সিদ্ধান্ত বিদ্যুৎ গ্রাহকদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। প্রিপেইড মিটার পদ্ধতিতে গ্রাহকদের আগাম টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ ক্রয় করতে হবে। যতক্ষণ প্রিপেইড কার্ডে টাকা থাকবে, ততক্ষণ গ্রাহক বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবেন, যা সেবামূলক খাতের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিদ্যুৎ আইন ২০১৮–এর ৫৬ ধারা মতে, গ্রাহকদের বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে কোম্পানিকে ১৫ দিন আগে নোটিশ দিতে হয়। কিন্তু এই প্রিপেইড মিটার পদ্ধতিতে কার্ডে রিচার্জ করা টাকা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, যা বিদ্যুৎ আইনের পরিপন্থী। বন্ধের দিনে টাকা না থাকলেও বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যাবে। কর্মদিবস শুরু হলে বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবে। রিচার্জের সঙ্গে ব্যবহৃত টাকা সমন্বয় করা হয়।
হাইকোর্ট বিভাগে গ্রাহক শোষণ ও হয়রানিমূলক প্রিপেইড মিটার স্থাপন বন্ধে একটি রিট পিটিশন চলমান, যা নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই বিদ্যুৎ বিভাগ তড়িঘড়ি করে এই প্রিপেইড মিটার সংযোগের কাজ করছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই প্রিপেইড মিটার সংযোগের সিদ্ধান্ত হয়। এই প্রিপেইড মিটার বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ভাই–বন্ধু নামে পরিচিত একটি চক্রের হাতে ছিল বলে অভিযোগ আছে। সেই চক্রটি এখনো সক্রিয়।
প্রিপেইড মিটারে গ্রাহকদের মিটার ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে ৪০ টাকা, ডিমান্ড চার্জ বাবদ (প্রতি কিলোওয়াট) ৩০ টাকা, ভ্যাট শতকরা ৫ টাকা ও রিবেট শতকরা ১ টাকা হারে পরিশোধ করতে হবে। প্রিপেইড মিটার পদ্ধতিতে এমনিতেই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিটপ্রতি চার্জ পায়। ফলে এক টাকাও বাড়তি আদায় করতে পারে না। এ ছাড়া প্রিপেইড মিটারে প্রতিবার এক হাজার টাকা রিচার্জে এজেন্ট কমিশন বাবদ ২০ টাকা গুনতে হয়। গ্রাহকদের টাকায় ক্রয়কৃত মিটার, অথচ সেই মিটারের জন্য ৪০ টাকা হারে ভাড়া কত দিন আদায় করা হবে, সেটিও অস্পষ্ট। আবার গ্রাহকেরা নিজেদের টাকায় এর আগে যে ডিজিটাল মিটার ক্রয় করেছিলেন, সেটি বাতিল করলেও এর জন্য কোনো টাকা বিদ্যুৎ বিভাগ পরিশোধ করেনি। প্রতি এক হাজার টাকা রিচার্জে গ্রাহকেরা কত ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবেন? বাণিজ্যিক ও আবাসিক রেট কীভাবে নির্ধারিত হবে—এসব নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। প্রিপেইড মিটারে ব্যালান্স শেষ হয়ে গেলে ২০০ টাকা ইমার্জেন্সি ব্যালান্সের জন্য ৫০ টাকা হারে গ্রাহকদের সুদ পরিশোধ করতে হবে। প্রিপেইড মিটার কোনো কারণে লক হয়ে গেলে লক খোলার জন্য ৬০০ টাকা জমা দিতে হবে। বিদ্যুতের ওভারলোডের কারণে অনেক সময় বিদ্যুৎ–প্রবাহ আপনা–আপনি বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া এই প্রিপেইড মিটারে রিচার্জ করার সঙ্গে সঙ্গে টাকা কেটে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকেরা কোথাও অভিযোগ করেও সদুত্তর কিংবা প্রতিকার পাচ্ছেন না। বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট না থাকলে প্রিপেইড মিটারে রিচার্জ করা যাবে না। কৃষিকাজে ব্যবহৃত সেচ পাম্পগুলো মৌসুমের শুরুতে কৃষকেরা বাকিতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। ফসল তুলে বিক্রি করে সেই টাকা পরিশোধ করেন। বর্তমানে প্রিপেইড মিটার পদ্ধতিতে আর সেই সুযোগ থাকছে না। পাশাপাশি প্রিপেইড মিটার স্থাপনের ফলে বিদ্যুৎ বিভাগের হাজারো কর্মচারী পেশা হারিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে। এই প্রিপেইড মিটার পদ্ধতিতে কোনো কারণে সার্ভার ডাউন হলে উক্ত সার্ভারের আওতাধীন প্রিপেইড মিটারের গ্রাহকদের জন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
সারা দেশের সব মানুষকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সেবার আওতায় নিয়ে আসার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অথচ সেটির পরিবর্তে একের পর এক গণবিরোধী সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সারা দেশের কোটি কোটি বিদ্যুৎ গ্রাহকদের স্বার্থকে উপেক্ষা করে কার স্বার্থে এই হয়রানি ও লুটপাটের প্রিপেইড মিটার প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদ্যুৎ বিভাগ মরিয়া হয়ে উঠেছে।
*লেখক: পলাশ কান্তি নাগ, আইনজীবী ও অ্যাকটিভিস্ট