ছুটি সমাচার
‘ছুটি’ শব্দটার মধ্যেই যেন ছুটে চলার মতো একটা ব্যাপার আছে। স্কুলজীবনে বিকেলের ক্লাস শেষে ছুটির ঘণ্টা বাজলেই আমরা এক ছুটে বেরিয়ে যেতাম স্কুলের আঙিনা থেকে। কর্মজীবনে ছুটির সংজ্ঞাও ঠিক তেমনই। একটু দম ফেলার ফুরসত পেলেই তাই আমরা ছুটে যাই নাড়ির টানে; দেশ-বিদেশে কোনো দর্শনীয় স্থানের ঠিকানায়।
আমাদের দীর্ঘ একঘেয়ে জীবনে একটুখানি শান্তির পরশ এই ছুটি। এর নেশায় আমরা সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে চাই। দিনের শেষে বাদুড়ঝোলা হয়ে নিজ আঙিনায় ফিরতেও তাই কোনো ক্লান্তি নেই। উৎসবের দিনে প্রিয়জনদের দেখা পেতে বাস-ট্রেনের শত ঝক্কি-ঝামেলা হাসিমুখে মাথা পেতে নিই।
ছুটির এ দৃশ্য যে শুধু আমাদের দেশে, বিষয়টা মোটেই এমন নয়। ইউরোপ-আমেরিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উৎসবের চেয়ে বড় আনন্দ গ্রীষ্মকালীন ছুটি। দুই থেকে তিন মাসের লম্বা ছুটিতে এ সময় তাঁরা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। অদেখাকে দেখা আর অজানাকে জানার সুযোগ দিতে তাঁদের ট্যুরিজম কোম্পানিগুলো চমৎকার সব অফার ছুড়ে দেয়। এ সময় পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই আপনি সাদা চামড়ার মানুষদের দেখা পাবেন। চাকরিজীবীদের জন্য সবচেয়ে বেশি অবকাশের ব্যবস্থা করেছে কম্বোডিয়া। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি; অর্থাৎ ২৮ দিন রয়েছে দেশটির ছুটির তালিকায়। এ তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। বছরজুড়ে দেশটিতে সরকারি ছুটির দিনের সংখ্যা ২৫। ছুটির দিন উপভোগের তালিকায় ভারতীয়রাও পিছিয়ে নেই। দেশটিতে প্রতিবছর বাৎসরিক সরকারি ছুটি ২১ দিন। এ ছুটির সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় নানা ধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই। সরকারি ছুটির তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে ফিলিপাইন। বছরে ১৮ দিন সরকারি ছুটি ভোগ করেন ফিলিপিনোরা। এর মধ্যে নতুন বর্ষ উদ্যাপন, স্বাধীনতা দিবস ও হলি উইক উল্লেখযোগ্য। আর বিভিন্ন উৎসব আমেজ মিলিয়ে ২২ দিনের সরকারি ছুটি উপভোগ করেন বাংলাদেশিরা।
বিভিন্ন জাতীয় দিবস হিসাব করে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ দেয়। কম্বোডিয়ার মতো ফ্রান্স ও ইতালি ৩৬-৪৮ দিন পর্যন্ত বাৎসরিক ছুটি দিয়ে থাকে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো সবচেয়ে কল্যাণমুখী হওয়ায় তাদের ছুটির পরিমাণও বেশি। বছরে ৩২-৩৮ দিনের অবকাশযাপনের সুযোগ পান তাঁরা। আর কাজপাগল জাপানিরাও বছরে সব মিলিয়ে ২৬ দিন ছুটি পান।
মনোবিজ্ঞান বলে, শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি নিয়ে পূর্ণ উদ্যমে কাজ করা সম্ভব নয়। তাই মানুষের নিয়মিতভাবে বিশ্রাম প্রয়োজন। সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের প্রয়োজন অবসর।
ছুটির দিনের হিসাব মিললেও অবকাশ উদ্যাপনের রকমফের আছে দেশগুলোতে। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশের নাগরিকদের মধ্যে পছন্দের কাজেই সময় পার করার প্রবণতা দেখা যায়। পরিবারকে সময় দেওয়া, ছবি আঁকা, বাগান করা, বই পড়া পশ্চিমাদের অবসরের প্রিয় কাজ। অনেকে এ সময় নানা স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে ছড়িয়ে পড়েন বিশ্বের নানা প্রান্তে। তাঁদের একটা বড় অংশ অবকাশের পুরো সময়টা নতুন নতুন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করেই কাটিয়ে দেন। তবে উৎসবমুখর দেশগুলোতে ভিন্ন আমেজ লক্ষ করা যায়। ভারত, শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশের অধিবাসীদের ছুটির একটা বড় অংশ কেটে যায় ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে করতেই।
আর্থসামাজিক কারণসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে ছুটির সংস্কৃতি ভালোভাবে গড়ে ওঠেনি। এখানে ছুটি মানেই কাজের জন্য বাড়তি সময় পাওয়া। এটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র—সব জায়গার জন্যই সত্য। দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটিতেও দেখা যায়, অফিসের বড়কর্তা একগাদা ফাইল ধরিয়ে দেবেন বাসায় বসে করার জন্য। বাবা-মায়েরা স্কুল ছুটি দিলে যারপরনাই বিরক্ত হন। ছোটবেলায় নানাবাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সময় বই-খাতা নিয়ে যাওয়ার ঘটনা কমবেশি সবার জীবনেই ঘটেছে। শিক্ষকেরা ছুটি দিলে বাড়ির পড়া যেন আরও বাড়িয়ে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ছুটি দিলেই একগাদা অ্যাসাইনমেন্ট ধরিয়ে দেন শিক্ষকেরা। অন্য দেশগুলো যেখানে কোনো একাডেমিক বছর শেষে ছুটি দেয়, সেখানে ছুটি থেকে ফিরে পরীক্ষার আসনে বসেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা।
চাকরিজীবীদের জন্য সবচেয়ে বেশি অবকাশের ব্যবস্থা করেছে কম্বোডিয়া। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি; অর্থাৎ ২৮ দিন রয়েছে দেশটির ছুটির তালিকায়। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। দেশটিতে সরকারি ছুটি ২৫ দিন। ছুটির দিন উপভোগের তালিকায় ভারতীয়রাও পিছিয়ে নেই। দেশটিতে প্রতিবছর বাৎসরিক সরকারি ছুটি ২১ দিন।
ছুটির অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হলো পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিয়ে কাজে ফেরার প্রস্তুতি। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ঘটে তার উল্টোটা। সপ্তাহজুড়ে ব্যক্তিগত যেসব কাজ জমে, সেগুলোই আমরা সম্পাদন করি ছুটির দিনে। তাই ছুটির দিনে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ তেমন হয় না। বরং পুরো সপ্তাহের ব্যক্তিগত কাজ জমার কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছুটির দিনগুলো হয়ে ওঠে কর্মদিবসের চেয়ে বেশি ব্যস্ততাপূর্ণ।
মনোবিজ্ঞান বলে, শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি নিয়ে পূর্ণ উদ্যমে কাজ করা সম্ভব নয়। তাই মানুষের নিয়মিতভাবে বিশ্রাম প্রয়োজন। সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের প্রয়োজন অবসর। বাস্তবতা হলো, অবসরযাপনের জন্য কর্মীকে ছুটি দেওয়ার রীতি আমাদের দেশে তেমন নেই। এ কারণ দেখালে ছুটি পাওয়ার সম্ভাবনাও যে অনেকটা কমে যায়, তা বলা বাহুল্য; বরং এ দেশে ছুটি পাওয়া যায় অসুস্থতায়। পরিস্থিতি এমন যে একজন মানুষ যতক্ষণ সুস্থ থাকবেন, ততক্ষণ তাঁকে কাজ করতে হবে।
আমাদের দেশে অফিসগুলোতে গেলেই দেখা যায়, একরাশ বিরক্তি নিয়ে কাজ করছেন সবাই। প্রশাসনিক কার্যক্রমের কচ্ছপগতির পেছনেও এ ছুটির বিড়ম্বনা কাজ করে। ছুটির পর অফিসে ফিরলেও আমরা কাজে ফিরতে পারি না। কেননা, কাগজে-কলমে ছুটি পেলেও বাস্তবিকভাবে আমরা অবসর পাই না। আমাদের এ স্থবিরতা আর উদ্যমের অভাবের পেছনের কারণ খুঁজে বের করতে হবে।
কিছুদিন আগে এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বেশি বেতন নয়, বরং যেসব চাকরিতে ছুটির পরিমাণ বেশি, সেসবে মানুষ বেশি আগ্রহী। এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। ওভারটাইম আর বাড়তি বেতনের লোভে আমরা অবকাশের সুন্দর সময়টাকে বিক্রি করে দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি, শিক্ষকেরা সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতেও নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উইকেন্ড বা কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন। এভাবে অর্থের পেছনে ছুটে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমরা সবাই।
‘বিশ্রাম কাজের অঙ্গ একসাথে গাঁথা’। তাই কাজের ফাঁকে ছুটি আর পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিয়ে ভাবতে হবে। যেকোনো কাজ প্রস্তুতিহীনভাবে করলে তার ভালো ফল পাওয়া যায় না। বিশ্রাম নেওয়ার মাধ্যমেই কাজে ফেরার জন্য প্রকৃত প্রস্তুতি নেওয়া হয়। আর উৎসব-পার্বণে শত মাইল পেরিয়ে নিজ গ্রামের পানে ছোটার প্রবণতা থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। নিজেকে সময় দেওয়াই হতে পারে ছুটির সবচেয়ে বড় সার্থকতা।
*লেখক: নোমান বিন হারুন, শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
**নাগরিক সংবাদে লেখা পাঠাতে পারবেন যেকেউ। ঠিকানা [email protected]