১৩–তে ‘মুক্ত আসর’

বিজয়ের ৪০ বছর উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় অনুষ্ঠিত হয় মুক্ত আসরের প্রথম অনুষ্ঠান ‘সাবাশ বাংলাদেশ’
ছবি: মুক্ত আসর

ছোট ছোট স্বপ্ন আর ছোট ছোট উদ্যোগ নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘মুক্ত আসর’। আজ থেকে ১২ বছর আগে, ২৮ মে ২০১১, শনিবার। মুক্তিযুদ্ধের অজানা ঘটনাগুলো নতুন তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার প্রয়াসে। ‘স্বপ্ন দেখি, দেশ গড়ি’—এটা ছিল আমাদের মূলমন্ত্র, স্লোগান। ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’—এ গানটি ছিল আমাদের সংগঠনের ‘থিমসং’।

সময় যে কত দ্রুত চলে যায়। দেখতে দেখতে একযুগ পেরিয়ে গেল। মনে পড়ে কত সংগ্রাম, ভালোবাসা, রাগ-অভিমান, ত্যাগ–তিতিক্ষা—এসব স্বীকার করে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ‘মুক্ত আসর’। আমার নানা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ। ছোটবেলা তাঁর সঙ্গে হাটবাজারে যেতাম। দেখা হতো অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। শুনতাম, অভাব-অনটনের নানা গল্প। তখন খুব কষ্ট হতো, যাঁরা দেশের জন্য নিজের জীবনটাকে উৎসর্গ করলেন, অথচ তাঁদের জীবন কী করুণ! ছোট মনে ভাবতাম, তাঁদের এই দুঃখকষ্টগুলো নিয়ে কিছু একটা করা যায় কী!

আরও পড়ুন
মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের তথ্যসংগ্রহ

ঢাকায় এসে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হই। সংগঠনের কাজ করছি। নানা অনুষ্ঠানের জন্য দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছি এক জেলা থেকে আরেক জেলায়। এর মধ্যে অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা হয়। ছোটবেলার আফসোসটা সব সময়ে তাড়া করত। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু একটা করার। মনে করলাম, তাঁদের অভাব-অনটন আমরা কোনো দিন পূরণ করতে পারব না, তবে আমরা যদি তাঁদের সংগ্রামের কথাগুলো লিখে রাখতে পারি, তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে পারি, তাহলে কিছু একটা করা হবে। রাতভর নানা স্বপ্ন। ঘুমহীন রাত। খাতা–কলম নিয়ে টেবিলে বসে পড়লাম। খাতায় লিখতে শুরু করলাম কীভাবে, কাদের নিয়ে এই কাজের যাত্রা শুরু করব। কারণ, একা তো বেশি দূর কাজ করতে পারব না। বেশি দূর যেতে, বেশি বেশি স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পারব না। দুই পৃষ্ঠার একটা চিঠি লিখলাম। যেখানে মূল বিষয় ছিল—অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করা, তাঁদের সংগ্রামের কাহিনি শোনা, লিপিবদ্ধ করা ও তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া।

মুক্ত আসরের আয়েোজন ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি...’

চিঠির ডাকে সাড়া পেলাম, কয়েকজন তরুণ তুর্কির। একেবারে শুরুর দিকে মহিউদ্দিন মধু, স্বর্ণময়ী সরকার, নাশিদ মুস্তারি, ইশরাত জাহান, মোহাম্মদ হাবিব, তাসনুভা অরিন, কৌশিক চাকমা, সিরাজ উদ্দিন, কাজী নাসরিন, আইয়ূব সরকার পরে মাকদুসউজ্জামান রবিন, বায়েজিদ ভূঁইয়া জুয়েল, উন্মে নূর কনা, মোহাম্মদ আলী, আশফাকুজ্জামান, আবু তাহের সোহেল, আলমগীর হোসেন, আনোয়ার হোসেনসহ অনেকেই। আর শিল্পী নিয়াজ চৌধুরী তুলি ছিলেন সব সময়ের জন্য আমাদের পাশে, আছেন। তিনি মুক্ত আসরের লোগোটা ভালোবেসে করে দেন। সব সময়ে আমাদের উৎসাহ দিতেন বীর প্রতীক তাহের আহমেদ, মেজর জেনারেল (অব.) মাসুদুর রহমান, এ কে এম জয়নুল আবেদীন, ডা. আহমেদ হেলাল, মোহিত কামাল, ফারাহ দিবা আহমেদ, নূরুন আকতারসহ অনেক প্রিয়জন। তাঁর প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা।

আরও পড়ুন
মুক্ত আসরের আয়োজন ‘বাংলাদেশকে জানো’

২৭ মে ২০১১, শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অপরাজেয় বাংলা’র পাদদেশে বসে আমরা ঠিক করলাম, আমাদের সংগঠনের যাত্রা। সবাইকে বলা হলো একটা নাম চিন্তা করার জন্য। তারপর সেটা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেব। প্রথম দিনে ‘ওরা ১১ জন’ ঠিক হলেও পরে খোলা আকাশের নিচে আমাদের মিটিংগুলো হওয়ার কারণে ঠিক করলাম ‘মুক্ত আসর’। সবাই রাজি হয়ে গেল। আমাদের কার্যক্রম পুরোদমে চলতে লাগল। আমরা এমনই সক্রিয় ছিলাম যেকোনো শুক্রবার আমাদের মিস হতো না। ঝড়বৃষ্টি কিংবা প্রচণ্ড ব্যস্ততা থাকলেও ঠিক সময়েই আমরা উপস্থিত হতাম।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দেওয়া ‘মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা’

এভাবে আমরা দল বেঁধে মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তাঁদের মুক্তিসংগ্রামের কথা শুনতাম। ছোট একটা ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করে রাখতাম। অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নেওয়া হলো। আর আমাদের চিন্তা ছিল, মুক্তিযুদ্ধের অনুষ্ঠান মানে ২৬ মার্চ আর ১৬ ডিসেম্বর নয়। মুক্তিযুদ্ধের অনুষ্ঠান হবে বছরজুড়ে। এ জন্য বিজয়ের ৪০ বছর অনুষ্ঠান উদ্‌যাপন করার জন্য ২৫ ডিসেম্বর ঠিক করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট। অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল ‘সাবাশ বাংলাদেশ’। শিশু-কিশোরদের নিয়ে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার। সেই আয়োজন তো ব্যাপক ধুমধামে অনুষ্ঠিত হয়।

বিজয়ের ৪০ বছর উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় অনুষ্ঠিত হয় মুক্ত আসরের প্রথম অনুষ্ঠান ‘সাবাশ বাংলাদেশ’

এই আয়োজন ছিল অনেক রকমের সংগ্রাম। প্রথম আয়োজন। বাজেট নেই। জনবল এত বেশি শক্তিশালী নয়। আমাদের উপদেষ্টা ফারাহ দিবা আহমেদ আমাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। তখন চারুকলায় পড়াশোনা করতেন মোহাম্মদ হাবিব। সেই হাবিব যে কত কষ্ট করেছে! খুব সফলভাবে শেষ হয় আয়োজনটি। তারপর একদিন সিদ্ধান্ত হলো মুক্তিযুদ্ধের লেখাগুলো নিয়ে একটা পত্রিকা প্রকাশ করার। পত্রিকার নাম ঠিক হলো—স্বপ্ন ’৭১। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ত্রৈমাসিক। দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক পত্রিকা।

অসহায় মানুষদের জন্য মুক্ত আসরের ‘ঈদ উপহার’

প্রকাশের জন্য নানাভাবে সহযোগিতা করলেন মেজর তাহের আহমেদ বীর প্রতীক। পত্রিকা প্রকাশিত হলো। নতুন নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে নানা উদ্যোগে কাজ করে যাচ্ছে ‘মুক্ত আসর’। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা প্রদান’ অনুষ্ঠান, স্কুলে স্কুলে ‘শোনো মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব গাথা’, বাংলাদেশকে জানো, ইতিহাস অলিম্পিয়াড, অসহায় মানুষদের সহায়তার জন্য ‘ঈদ উপহার’, নজরুল চর্চার জন্য ‘আমিই নজরুল’ বই সম্পর্কে জানানোর জন্য বইবিষয়ক পত্রিকা ‘বইচারিতা’, সৃজনশীল ও মননশীল বই প্রকাশের জন্য ‘স্বপ্ন ’৭১ প্রকাশন’, কর্মশালা, ১০০ শব্দের গল্প লেখা প্রতিযোগিতা, সেরা লেখক পুরস্কার, চলচ্চিত্র উৎসব, আন্তর্জাতিক সম্মেলনসহ নানা উদ্যোগ।

আরও পড়ুন
মুক্ত আসরের উদ্যোগে ‘ইতিহাস অলিম্পিয়াড’ আয়োজন

নানা উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ডে আমাদেরকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। নিশ্চয়ই আগামী দিন আমরা আরও অনেক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হব, সবার সহযোগিতা পাব।

জয় হোক আমাদের, জয় হোক আমাদের সব কর্মকাণ্ডের।

আবু সাঈদ: প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, মুক্ত আসর