রেললাইনের পাশে ১২০ কিমি গতির যান চলাচলের লেন করলে কেমন হয়?
সুইডেনপ্রবাসী রহমান মৃধা (দূর পরবাসে লেখেন) কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা ভিডিও দিয়েছিলেন। তিনি গাড়িতে বসে ছিলেন আর তাঁর ছেলে ১৮০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় গাড়ি চালাচ্ছিল জার্মানির একটি রাস্তায়। এসব রাস্তাকে বলা হয় অটোবাহনেন (Autobahnen)। দ্রুতগামী গাড়ি চলাচলের জন্য বিশেষায়িত রাস্তা এগুলো। এসব রাস্তার গতির সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া নেই। তখন ভাবলাম, ভাইরে ভাই, এই গতিতে ৪-৫ ঘণ্টায় দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত যাওয়া যাবে। যেখানে ঈদে আমার বাড়ি পৌঁছাতে সময় লেগেছিল মোটে ২৪ থেকে ২৬ ঘণ্টা। অনেকের এ ধরনের অভিজ্ঞতা আছে। সে যাহোক, পরে ভাবলাম আমাদের দেশের যাতায়াতব্যবস্থা কীভাবে উন্নতি করা যায়? আর এমন গতির রাস্তা পেতে আমাদের আর কত যুগ অপেক্ষা করতে হবে?
ঢাকা থেকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) যাচ্ছিলাম ট্রেনে করে। দেখছিলাম রেললাইনের আশপাশে বেশি একটা বসতি নেই। ট্রেনের শব্দের কারণে আসলে মানুষ একটু দূরে দূরে বসতি স্থাপন করে। তা ছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশ ভালো লাগছিল। তখন একটা চিন্তা এল মাথায়। রেললাইনের দুই পাশের ফাঁকা জায়গায় রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা।
আমাদের বর্তমান যাতায়াতব্যবস্থা—
১.
একই রাস্তা দিয়ে দূরপাল্লার যানবাহন বাস, মাইক্রোবাস আবার পণ্যবাহী ট্রাক, পাথর বোঝাই করা ট্রাক, লোকাল যানবাহন যেমন অটোরিকশা, নছিমন, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভারতের পণ্যবাহী ট্রাক, মোটরসাইকেল, সাধারণ সাইকেল, সিএনজি—সবকিছু চলে। আমি আবারও বলছি, এগুলো একই রাস্তা দিয়ে চলে।
২.
প্রতিবছর দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ মারা যায়, পঙ্গু হয়, কেউ বাবা হারায়, কেউ মা, কেউ ছেলেমেয়ে হারায়, কেউবা সপরিবারে নিহত হয়। কত রকমের যে দুর্ঘটনা ঘটে, হিসাব নেই।
৩.
যে গন্তব্যে যেতে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা লাগে সেখানে ৫ থেকে ৭ ঘণ্টায়ও যাওয়া যায় না। প্রচণ্ড ট্র্যাফিক জ্যাম। আর ঈদের সময় তো কোনো কথাই নেই। পুরোই অনিশ্চিত, কবে পৌঁছাবেন বা আদৌ পৌঁছাবেন কি না!
৪.
ট্রেনে যাতায়াতে দুর্ভোগ একটু কম, তবে টিকিট পাওয়া মুশকিল। ওয়েবসাইটে টিকিট ছাড়ার ২ মিনিটের মধ্যে টিকিট নেই। কোথায় গেল টিকিট? টিকিট কালোবাজারি, ট্রেনের পার্টস চুরিসহ এই খাতেও দুর্নীতির শেষ নেই। পুরোই লস প্রজেক্ট। আয় তো নেই আবার উল্টো সরকারকে প্রচুর টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। পত্রপত্রিকা একটু ঘাঁটলেই তাদের দুর্নীতির কথা বোঝা যায়। মাঝেমধ্যেই অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় এসব নিয়ে।
৫.
এসব ছাড়াও অজ্ঞান পার্টি, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণসহ আরও কত ঘটনাই যে ঘটে। রাস্তায় নিরাপত্তার অভাব মানুষকে শান্তিতে গন্তব্যে পৌঁছাতে দেয় না। কত মানুষ যে খুন হয় এসব খপ্পরে, তার তো সঠিক হিসাবও নেই। আরও অনেক কিছু বলা যেতে পারে যাতায়াতব্যবস্থা নিয়ে। তবে আমি এখানেই শেষ করলাম।
পরিকল্পনাটি যেমন হতে পারে—
১.
রেললাইনের দুই পাশ দিয়ে দুই-দুই চার লেন রাস্তা থাকবে।
২.
এক দিকের দুই লেন যাওয়ার এবং আরেক দিকের দুই লেন আসার। যানবাহন সব সময় যেকোনো এক লেন দিয়ে চলবে। আর আরেক লেন থাকবে কোনো অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির জন্য। যেমন: গাড়ির কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি হলে থামতে হতে পারে। তখন এই লেন কাজে লাগবে।
৩. এই রাস্তা দিয়ে যেসব যানবাহন চলবে, সেগুলো পরীক্ষিত এবং ভালো মানের হতে হবে।
৪.
শুধু অনুমোদিত যানবাহন এসব রাস্তায় প্রবেশ করতে পারবে।
৫.
রাস্তার দুই পাশে প্রাচীর দেওয়া থাকবে যাতে মানুষ, গরু ছাগল বা অন্যকিছু হঠাৎ রাস্তায় উঠতে না পারে।
৬.
মানুষের এক পাশ থেকে অন্য পাশে যাওয়ার জন্যে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর বা প্রয়োজনীয় স্থানগুলোতে উড়ালসেতু বা পদচারী–সেতুর ব্যবস্থা থাকবে।
৭.
রেলস্টেশন যেমন থাকবে, তার পাশে এসব যানবাহন থামারও জায়গা থাকবে। মূলত রেলস্টেশনের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে ব্যবস্থা করা হবে।
৮.
সব গাড়ি একটি নির্দিষ্ট গতিতে চলবে। হতে পারে ১২০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। রেললাইনের রাস্তাগুলো তুলনামূলক সোজা এবং আঁকাবাঁকা কম হওয়ায় এ গতি বজায় রাখা চালকদের জন্য অনেক সহজ হবে।
৯. যেহেতু সব গাড়ি একই গতিতে চলবে, তাই ওভারটেকিং করার সুযোগ কম বা নেই।
১০.
রাস্তায় পুলিশ ২৪ ঘণ্টা টহল দেবে, সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে নজরদারি করবে, গতি পরিমাপক যন্ত্র দিয়ে গতি পরিমাপ করবে। রাস্তায় ঢোকার সময় যানবাহন–সংক্রান্ত যা কিছু চেক করার প্রয়োজন পুলিশ চেক করবে না, চেক করবে দক্ষ মেকানিক। পুলিশ মাদক বা অন্য কোনো নিরাপত্তার বিষয় চেক করতে পারে। মূল রাস্তায় ঢোকার পর এসব করে রাস্তার গতি আটকানোর বিশেষ প্রয়োজন নেই।
১১.
এ রাস্তায় যে পুলিশ টহল দেবে, তাদের জন্য বিশেষ গাড়ি থাকবে, যাতে সহজে ২০০-২৫০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতি তোলা যায়। কারণ, রাস্তার সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীরাও আপগ্রেডেড হবে। একবার ভেবে দেখুন, কী পরিমাণে দুর্ঘটনা কমে যাবে! প্রতিবছর হাজারো মানুষ মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়, পঙ্গুত্ব বরণ করে! ইনশা আল্লাহ, সেগুলো কমে যাবে। ঈদে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় ভোগান্তি কী পরিমাণে কমবে! সময় কত বাঁচবে!
সুবিধা
১.
প্রথম এবং প্রধান সুবিধা দেশের জন্য হলো ‘লস প্রজেক্ট রেল ব্যবস্থা’ টিকে কিছুদিনের জন্য অবসরে পাঠাবে।
২.
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে কিছুদিন সময় দেবে রেল যোগাযোগব্যবস্থা কীভাবে সর্বাধুনিক করা যায়, সেটার পরিকল্পনা করতে। সর্বাধুনিক করার উপায় আগে একটা লেখায় উপস্থাপন করেছিলাম।
৩.
অন্যান্য সুবিধা যেমন যাতায়াতে সময়, ভোগান্তি কমবে। এসব বিষয় একটু আপনারাও কল্পনা করুন।
অসুবিধা
অসুবিধা বেশি দেখি না। অসুবিধা বা সমস্যা থাকলে সেসব বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে সমাধান করা যাবে। তবে, এসব মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করার প্রধান ভয় এবং প্রতিবন্ধকতা হলো মেগা দুর্নীতি। তাহলে মূল অসুবিধা হলো দুর্নীতি।
প্রতিবন্ধকতা
প্রতিবন্ধকতা অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা আছে আমাদের দেশের বা আরও প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে। সেসব প্রতিবন্ধকতাও দূর করা সম্ভব। আমরা পদ্মা সেতু তৈরি করেছি, আমরা চেষ্টা করলে এ ধরনের প্রকল্পও বাস্তবায়ন করতে পারব ইনশা আল্লাহ।
*লেখক: মো. গোলাম সারোয়ার সাইমুম, শিক্ষার্থী, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়