তুমি নিদ্রা ভেবে ভুল কোরো না

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ককটেল ফাটানোর আওয়াজ ‍শুনলে কি ঘুমিয়ে থাকা যায়? সে রকম কিছু একটা শুনলাম মনে হচ্ছে। আমার ঘুম এত বাজেভাবে ভেঙেছে যে বুক ধুকপুক করছে। মোবাইল বিস্ফোরণে কি এমন আওয়াজ হয়?

না, বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ঠিক আছে। সময় দেখাচ্ছে রাত ২টা বেজে ৪২ মিনিট। সিলিং ফ্যান খুলে পড়েছে নাকি? কার মাথায় পড়ল?

না, ফ্যানও পড়েনি। কিন্তু ঘুরছে না। চলতে চলতে বন্ধ হয়ে গেল নাকি লোডশেডিং? বিকট আওয়াজটা কিসের ছিল?

বড়জোর দেড় ঘণ্টা ঘুমিয়েছি। ঘুমের কথা ভাবতেই মোহগ্রস্তের মতো চোখটা আবার জুড়িয়ে আসছিল। এমন সময় কে যেন চিৎকার করে উঠল, আগুন, আগুন লাগছে।

এত রাতে আগুন? আর টাইম পেল না। নড়াচড়া শুনে মনে হচ্ছে অন্যরাও জেগে উঠেছে। কত কাজ বাকি! সকাল সকাল উঠে সব সেরে নিতে হবে। একটু দেরি হলেই ত্যাগের জন্য লাইন লেগে যাবে। তখন পেট চেপে বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকবে না। এখন আগুন লাগলে কখন ঘুমাব আর কখন উঠব?

এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে টের পেলাম, মনসুর হন্তদন্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। না, ছেলেটার ওপর রাতবিরাতেও ভরসা করা যায় না। সবকিছুতেই অতি সিরিয়াস। সে কি এখনই ওয়াশিংটন দখল করবে?

মেসের একমাত্র ‍ওয়াশরুমকে সবাই এই নামেই ডাকে। পেট চেপে থাকার শঙ্কা নিয়ে কোনোমতে মাথাটা তুলে মনসুরকে বললাম, এই মধ্যরাতে কই যাস?

সে শুনে বলল, আগুন লাগছে। এক্ষুনি বেরোতে হবে।

তার তাড়া দেখে আনোয়ার বলল, আগে কোথায় লেগেছে দেখ।

সেটা দেখার জন্যই তো যাচ্ছি, বলেই মনসুর এমনভাবে গায়েব হয়ে গেল যেন আমরা জেগে উঠেছি দেখে তার ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর মনসুর ফিরে এসে তার স্বভাবসুলভ উত্তেজনায় বলল, ট্রান্সফরমার ব্লাস্ট হয়ে আগুন ধরে গেছে, ফায়ার সার্ভিসকে ফোন কর।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]

তার কথা শুনে শোয়া থেকে উঠলাম জানালা দিয়ে দেখার জন্য। বাইরে বেশ শোরগোল। আশপাশের প্রায় সবাই জেগে উঠেছে। আমার মতো অলস কেউ কেউ জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছে দেখে ভরসা পেলাম। একজন বলল, পানি ঢাল।

গলাটা বোধ হয় পাশের বাড়ির মালিকের। ট্রান্সফরমারেও পানি ঢালতে বলছে!

আমাদের নিশ্চল অবস্থা দেখে মনসুর আবার চেঁচিয়ে বলল, শুনতে পাসনি? ফোন দে।

তার পীড়াপীড়ি দেখে ইমাদ বলল, ব্যস্ত দেখাচ্ছে। কল ঢুকছে না।

মনসুরের উত্তেজনা কমাতে তাকে বললাম, কেউ না কেউ নিশ্চয়ই ফোন করে দিয়েছে।

এ কথা শুনে মুখে ভেংচি কেটে ফখরুল আর ইমাদকে নিয়ে মনসুর বেরিয়ে গেল আগুন নেভাতে। আর বলে গেল, তোরা তো যাবি না। তাই বলে ঘুমিয়ে পড়িস না। পাহারা দে।

তার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে ফখরুল বলল, বিপদে চোরের উৎপাত বাড়ে।

আমার এমনিতে ঘুম আসবে না। আজ কেন জানি আমার চোখ জুড়িয়ে আসছে। আমি টের পাচ্ছি আগুন বাড়ছে তরতর করে। বাইরের শোরগোল চেঁচামেচিতে রূপ নিচ্ছে। কেউ বালতি চাইছে। কেউ বলছে, বালি লাগবে, বালু। দূরে কে জানি উচ্চস্বরে সুরা আম্বিয়ার ৬৯ নম্বর আয়াত পড়ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি, বালু-বালতি-পানি না পেয়ে মনসুর আগুনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আগুনের ফুলকির মতো কে জানি থেমে থেমে অস্পষ্ট স্বরে চিৎকার করে বলছে, ঘুমিয়ে পড়িস না। পাহারা দে।

আমি নিজের কিছু টের পাচ্ছি না। একবার মনে হলো জেগে আছি। আরেকবার মনে হচ্ছে আমি কোনো নদীর পাশে বসে আছি। নদী থেকে হঠাৎ কিছু্ একটা ছিটকে এসে গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিল। আমি উহ্ করেই চোখ মেলে দেখি অন্ধকার। পাশের রুমে কারা জানি পাল্লা দিয়ে নাক ডাকছে। বালিশের পাশে মোবাইল রাখা। সময় দেখতে ইচ্ছা করছে না। ইমাদকে ডেকে বললাম, কোথাও কি আগুন লেগেছে?

সে চোখ না খুলেই বলল, না।

একবার মনে হলো মনসুরকে ডাকি। কিন্তু কীভাবে ডাকব? সে তো শুয়ে আছে কুশিয়ারার পারে। তার ঘুম অনন্ত। ডাকলেও ভাঙবে না।