এক রাজকন্যার প্রস্থান

ছবি: এআই/ প্রথম আলো

এক রাজকন্যার প্রস্থানের কথা লিখছি। যিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। যে বাগান থেকে এসেছিলেন, সেই বাগানেই আবার চলে গেলেন। যাঁর এক আত্মীয় ওনার ছবি বুকপকেটে নিয়ে ঘুরতেন এক রাজকন্যাকে দেখবেন বলে। হ্যাঁ, সেই রাজকন্যা আমার মা সৈয়দা হোসনে আরা মাহমুদা বেগম (হাসনা)। ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট ৮৩ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

মহান আল্লাহ তাআলার কী অপূর্ব সৃষ্টি ছিলেন আমার মা। এত সুন্দর বান্দা তিনি এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন, যেমন ছিলেন বাহ্যিক দিকে সুন্দর-চাঁদপানা কপাল, বড় বড় চোখ, টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁট, গায়ের রং দেহের গড়ন। তাঁর ভেতরটা ছিল আরও সুন্দর।

বাবা মরহুম মাওলানা সৈয়দ আবদুর রহমান, মা মরহুমা সুফিয়া খাতুনের মেয়ে বলেই হয়তো প্রভু এত সুন্দর করে গড়েছিলেন। দুর্লভ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন আমার মা। কোনো দিন কারও সমালোচনা করতেন না, কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন না। এত বড় বাড়ির মেয়ে ছিলেন, কোনো দিন কাউকে হুকুম দিতেন না। কেউ কষ্ট দিলেও মুখ ফুটে প্রতিবাদ করতেন না। নানা বলেছিলেন ‘বড় শত্রুকে বড় পিড়াটা দাও।’ আমরা ছোটবেলায় দেখেছি নানা বুবু মামা, মা—একসঙ্গে বসবাস করতেন। হাসি, গল্প, আনন্দ, মজার মজার খাবার এক সুখের ফুলবাগানে বসবাস করতেন। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ, কাউকে কোনো কটু কথা বলা, এসব আমরা দেখিনি। এত বড় বাড়ি, এত কাজের লোক, কোনো অশান্তি ছিল না। ওনাদের জমিদারবাড়িতে পুণ্যাহ হতো। প্রজারা আসত খাজনা নিয়ে, প্রজাদের জন্য অনেক খাবারদাবারের ব্যবস্থা থাকত। খুব আদরের ছিলেন মা। বাবা, দাদা (বড় ভাই) বলতে অজ্ঞান ছিলেন। মামা কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেছিলেন। মা–ও কলকাতায় গেছেন নানার সঙ্গে। নিজের পরিবারের আত্মীয়স্বজনের কাছে মা খুব আদরের, স্নেহের ও ভালোবাসার পাত্রী ছিলেন। গ্রামের এক খালাম্মা বলেছিলেন, ‘তোমার মা ওই সময় ভুলে আসত, কাজের লোক বইয়ের ব্যাগ নিয়ে আসত, আমরা অবাক হয়ে দেখতাম।’

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

মা বিদ্যাময়ী স্কুলে পড়তেন। প্রতি সপ্তাহে অধীর আগ্রহের অপেক্ষা করতেন কবে তাঁর বাবা আসবে। ১৭ বছর বয়সে মায়ের বিয়ে হয়েছিল। আমার আব্বা তখন ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজে বিএসসি পড়তেন। দাদা ছিলেন টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী স্কুলের হেড মাওলানা। দাদিও ব্রিটিশ আমলে গ্রামের স্কুলে মেয়েদের পড়াতেন। উনিও জমিদারবাড়ির মেয়ে ছিলেন। ওনার চাচাদের কলকাতায় ফলের ব্যবসা ছিল।

মা সব সময় তাঁর চার সন্তানের মাথার ওপর বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে ছিলেন। সব বিপদ-আপদ থেকে আমাদের আগলে রাখতেন। ছোটবেলায় মা আমাদের লেখাপড়া করাতেন। আমাদের কখনো কোনো কাজের কথা বলতেন না, শুধু পড়ালেখা করতে বলতেন। সব সময় সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে বলতেন। মেয়ের জামাইদের, ছেলের বউকে, নাতি-নাতনিদের খুব ভালোবাসতেন। ছেলে ছিল তাঁর প্রাণ। কাজের লোকদের সঙ্গে সব সময় ভালো ব্যবহার করতে বলতেন। তাঁদের ভালো খাবার দেওয়া, তাঁদের বিধান দিতে বলতেন। তাঁদের সঙ্গে গল্প করতেন।

লেখকের মা। ছবি: লেখকের পাঠানো

মা আমার এই বয়সেও আল্লাহর রহমতে সুস্থ ছিলেন। কিন্তু খেতেন খুব কম। ২০১৯ সালের ৪ জুলাই একজন নিউরোলজিস্টকে দেখালাম। ইসিজি, ব্লাড রিপোর্ট সব ভালো। মা স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতেন। ২৫ জুলাই ২০১৯ মা পড়ে গিয়ে মাথায় ব্যথা পেয়েছিলেন। চারটা স্টিচু লেগেছিল। হাসপাতাল থেকে ব্যান্ডেজ করে তিন দিন পর নিয়ে যেতে বলেছিল। ২৮ তারিখ দুপুরে মা ঘুম থেকে উঠে কথা বলছিলেন এবং হাঁটাহাঁটি করছিলেন। একসময় খুব জোরে জোরে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ কলেমা পড়তে আরম্ভ করলেন। আমরা সবাই কাঁদতে থাকলাম এবং মাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। বিকেল চারটায় হাসপাতালে ভর্তি হলেন।

রাত ১০টার পরে ডাক্তার এসে টেস্ট করে বলল ডেঙ্গু। আইসিইউতে নিয়ে গেল। ৩১ তারিখে কেবিনে দেওয়া হলো এবং ডাক্তার বলল এখন ভালো আছে। ৩ তারিখ রাতে ছটফট করতে ছিলেন, ঘুমাচ্ছিলেন না। তখন একটা ঘুমের ট্যাবলেট ওনাকে দেওয়া হলো। ৪ তারিখ সকাল থেকে উনি খুব চুপচাপ হয়ে গেলেন। কোনো কথা বলছিলেন না। সকালে ব্লাড টেস্ট করে দেখা গেল হিমোগ্লোবিন খুব কম, ব্লাড দিতে হবে। বিকেল পাঁচটায় ডাক্তার এসে দৌড়াদৌড়ি করে আবার আইসিইউতে নিয়ে গেলেন। বললেন হার্টের পাম্প কাজ করছে না। মা আর চোখ খোলেননি, কথাও বলেননি। ডাক্তার রোজ সকালে এসে দেখে বলতেন ওনার হার্ট ও কিডনি ভালো আছে কিন্তু কনসাস লেভেল বাড়ছে না। এক দিন আইসিইউতে দেখে এসে আমার বোন বলল ‘মা যেন পরিপাটি হয়ে শুয়ে আছেন। ১৭ আগস্ট, ২০১৯ আমরা অন্য একটা হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। এর মধ্যেই মায়ের জন্য হজে গিয়ে আত্মীয়স্বজনেরা তাঁর সুস্থতার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছেন। দেশে আব্বার গ্রামে, মায়ের গ্রামে ও ঢাকায় বিভিন্ন মসজিদে এতিমখানায় দোয়া হয়েছে। সদকা দেওয়া হয়েছে, এতিমদের খাওয়ানো হয়েছে। বড় বড় ডাক্তারেরা সবাই দেখছেন। আমি একদিন আইসিইউতে গিয়ে দেখলাম মা যেন বেহেশতি ফুল হয়ে বেডে শুয়ে আছেন। সেই মা আমার ২৮ আগস্ট না ফেরার দেশে চলে গেলেন।

স্নেহময়ী মা আমার এভাবে যে চলে যাবেন, ভাবিনি। কেন ভাবিনি সে জন্যই এত কষ্ট পাচ্ছি। এ পৃথিবীতে তাঁর শেষ কথা ছিল ৪ আগস্ট ২০১৯ মধ্যরাতে হাসপাতালের বেডে শুয়ে ‘মাগো, ও মা আমাকে কোলে নিবি’। কেন আমার মা আমাকে এ কথা বলেছিলেন। প্রভু তাঁর মুখ দিয়ে ইহলোকের এই শেষ কথায় কিসের ইশারা দিলেন আমাকে?

এক রাতে বাসায় বিছানায় শুয়ে আমি বলেছিলাম, ‘মা নানা তোমাকে খুব আদর করতেন, তোমাকে ডাকতেন হাছনু বলে। মা কী সুন্দর করে আদুরে ছোট মেয়ের মতো বললেন ‘হাছন’। মনে হলো বেহেশত থেকে ভেসে আসা একটা মধুর শব্দ আমার কানে প্রবেশ করল ‘হাছনু’। এখনো আমি শুনি সেই মধুর ধ্বনি—‘হাছনু’।

মহান রাব্বুল আলামিন মাকে ভালো রাখুন, জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।

* লেখক: ফওজিয়া জাফরিন, মেয়ে, গ্রিন রোড, ঢাকা