বিয়েবাড়ির একাল-সেকাল

চলছে বিয়ের মৌসুম। খুব গরম নয়, ঠান্ডাও নয়। বিয়ে করার উপযুক্ত সময়। আমরা যারা নব্বইয়ের দশকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়েছি, তাদের কাছে বিয়ে মানে গায়েহলুদ, বিয়ের অনুষ্ঠান আর বউভাত। এই তিন আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে বিয়ের আয়োজন শেষ করা হতো। এনগেজমেন্টের ব্যাপারটি ছিল অপশনাল।

হলুদের অনুষ্ঠানে বর হোক আর কনে, মুরব্বিরা তাঁদের কপালে হলুদ ছোঁয়াতেন। মিষ্টিমুখ করাতেন। সবশেষে হাতে মেহেদি দেওয়া হতো। কেউ কেউ সালামি হিসেবে বর বা কনের হাতে টাকা দিতেন। বিয়ের অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল ভিডিও করা। ক্যামেরাম্যানরা সবকিছুর ভিডিও ধারণ করতেন।

মজার ব্যাপার ছিল, সারা দিন ক্যামেরাম্যানের দেখা না পেলেও খাওয়ার সময় দেখা যেত মুখের সামনে ক্যামেরা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। সবশেষে বউভাত। বউভাতের একাল-সেকালে তেমন কোনো পার্থক্য দেখা যায় না।

বর্তমানে ৮ থেকে ১০টি অনুষ্ঠান না করলে সমাজে স্ট্যাটাস থাকে না। এর মধ্যে আগের চারটি তো আছেই; নতুন সংযোজনের মধ্যে রয়েছে ব্রাইডাল শাওয়াল, প্রিম্যারেজ ফটোশুট, মেহেদিসন্ধ্যা, পোস্টম্যারেজ ফটোশুট, ব্যাচেলর পার্টিসহ আরও কত-কী। এসব অনুষ্ঠান না করলে বিয়ের কোনো মানেই হয় না। প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যান ছাড়া ফটোশুট করা যাবে না। বিখ্যাত কয়েকজনের হাতে না সাজলে কাউকে চেহারা দেখানো যাবে না। হলুদের অনুষ্ঠানে বর অথবা কনের কপালে হলুদ ছোঁয়ানো যাবে না (পারলারের নিষেধ)। হলুদের অনুষ্ঠান মানে লাইভ নাচ-গান। কোন পক্ষ কত ভালো পারফর্ম করল, তা নিয়ে আলোচনা। বিয়ের অনুষ্ঠানের একটি সেকেন্ডও নষ্ট করা যাবে না। বর-কনের প্রতিটি মুহূর্ত বিভিন্নভাবে ক্যামেরায় ধারণ করা হয়। কারও সঙ্গে কারও কথা বলার সুযোগ নেই, সবাই নিজেদের সৌন্দর্য প্রদর্শনে ব্যস্ত। দেনমোহরের কথা নাহয় না–ই বললাম।

এভাবে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে বিশাল অর্থের জোগান দিতে অভিভাবকেরা কখনো কখনো বিপদে পড়েন, আবার কখনো আমন্ত্রিত অতিথিরাও। এত বড় আয়োজন, গিফট হতে হবে বেশি দামি। ড্রেসকোড মেনটেইন করতে গলদঘর্ম হওয়ার মতো অবস্থা। পুরো ব্যাপারই হলো নিজেকে জাহির করা।

অনুষ্ঠান শেষে একদল লোক খুব পজিটিভ কথা বলে, আরেক দল নেগেটিভ। আরেক দল লোক আছে, যারা দুই পক্ষকেই সমর্থন করে তর্কের সৃষ্টি করে। সে যা-ই হোক, এখানে একটু ভেবে দেখার বিষয় হচ্ছে, এত জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করেও বিয়ে দেওয়া যায়, আবার কিছু খোরমা দিয়ে মসজিদে বসেও বিয়ের কাজটি শেষ করা যায়। আপনি কোনটাকে বেছে নেবেন, সেটা আপনার পছন্দ। বিয়েটা হচ্ছে একটি পবিত্র সম্পর্কের বন্ধন। এ বন্ধন যত সহজভাবে তৈরি হবে, বিয়েটা ততই মজবুত হবে।

হয়তো আপনার অনেক টাকা আছে, কিন্তু তা শো অফ করার মধ্যে কোনো বড়াই নেই। যাঁদের জন্য এত কিছু, তাঁদের ব্যাপারে চিন্তা করি না। তাঁরা তো একটা নতুন সংসার শুরু করতে যাচ্ছেন। শো অফ না করে এ খরচ যদি তাঁদের দিয়ে দেওয়া যেত, তাহলে তাঁরা নতুন সংসারে প্রয়োজনমতো জিনিস কিনতে পারতেন, কোথাও একটা ট্যুর দিতে পারতেন অথবা নিজের ক্যারিয়ার গড়ার কাজে লাগাতে পারতেন। অর্থের এই অনর্থক ব্যবহার নিয়ে আমরা কখনো চিন্তা করি না। অর্থের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের জীবনকে সার্থক করে তুলতে পারি।

  • লেখক: ফারজানা বেগম, সিনিয়র শিক্ষক, অ্যাপল ট্রি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল