শেষের শুরুতে আনন্দমুখর একটি দিন

দিগন্তে ছুটির ঘণ্টা বাজছে। বিদায়ের সেই সুর ধীরে ধীরে ক্ষীণ থেকে প্রবল হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অজানা-অপরিচিত ১০৭ জন শিক্ষার্থীর ধীরে ধীরে আপন হয়ে ওঠা, মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নেওয়া আর শেষে এসে তাদের ছেড়ে যাওয়ার নিঃশব্দ ক্রন্দন যেন আবেগের ঢেউ হয়ে সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের প্রান্তে এসে শুরু থেকে আজ অবধি তৈরি হওয়া সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার স্মৃতিগুলো বারবার চোখের সামনে ভিড় জমাচ্ছে। সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট, বিচ্ছেদের যন্ত্রণা যেন এখন থেকেই আমাদের পেয়ে বসেছে।

আমরা পড়াশোনা করছি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষে। দেখতে দেখতে এখন স্নাতকের দোরগোড়ায়। বছরখানেকের মধ্যেই শেষ করতে যাচ্ছি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন। এই শেষ ভাগে এসে সবার মধ্যে পুনরায় এক হওয়ার আগ্রহ ছিল প্রবল। তাই নিজেদের বন্ধুত্ব আরও মজবুত করতে, শেষটা আরও রঙিন করতে, স্মৃতির ডায়েরিতে আরও একটি আনন্দময় দিনের বর্ণনা লিখতে আমরা করি চড়ুইভাতির পরিকল্পনা।

চড়ুইভাতির দিনটা বুধবার হলেও আমাদের মধ্যে উদ্দীপনা ছিল আগে থেকেই। আকিবের চড়ুইভাতির পরিকল্পনা উপস্থাপনের দিন থেকেই সবার মধ্যে এই আয়োজনের ব্যাপারে আগ্রহ ছিল লক্ষণীয়। এর আগেও এ রকম দুটি আয়োজনের অভিজ্ঞতা থাকায় সিদ্ধহস্ত আয়োজকেরাও একবাক্যে রাজি হয়ে যায়।

নির্ধারিত দিনের আয়োজন কেন্দ্র করে আগের দিন সদাইয়ের তালিকা ও পরিমাণ নির্ধারণের গুরুদায়িত্ব পড়ে ফিরোজের কাঁধে। বরাবরের মতো এবারও সে এই কাজে মুনশিয়ানা দেখায়। বাজারতালিকা প্রণয়নের পর আমরা সদাই কেনার জন্য দল বেঁধে চলে যাই পার্শ্ববর্তী শেখপাড়া বাজারে। এই যাত্রায় সঙ্গে ছিল সোহাগ, রায়হান, শামীম, জুবায়ের, সবুজ ও হুমায়ুন। শীতের সময়, দিন ছোট! তাই পরদিনের কাজ কমিয়ে রাখা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সুতরাং মসলা প্রস্তুতের জন্য আমরা আসিফের রুমে ভিড় জমাই। সেখানে এক রমরমা পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মনে হচ্ছিল কারও বিয়ের অনুষ্ঠানের কাজ সুসম্পন্ন করতে কর্মচঞ্চল একদল যুবক!

কাজ শেষে আয়োজকেরা নিজ নিজ রুমে ফিরে আসি। পরদিন আয়োজন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা এবং সে জন্য নিজেদের সুস্থ রাখতে যথেষ্ট ঘুমানোর দ্বান্দ্বিকতায় সে রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি আমাদের। তবু প্রভাতেই প্রস্তুত আমরা! সকালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। খুব ভোরেই দেখেশুনে খাসির মাংস কেনার কাজটা যথাযথভাবে সম্পন্ন করে সবার সঙ্গে যোগ দেয় কাইয়ুমও। পরে ডেকোরেট থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে সকাল নয়টার মধ্যেই আমরা সবার পছন্দের পিকনিক স্পট শ্রীরামপুর সাঁকোর ঘাটে পৌঁছে যাই।

পিকনিক স্পট হিসেবে শ্রীরামপুর ছিল অসাধারণ। স্থানটি নদী ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মিলনস্থল বললে ভুল হবে না। কালী নদীর ওপর দিয়ে গ্রামবাসীর উদ্যোগে নির্মিত কাঠের সেতু পার হয়েই তাঁদের পক্ষ থেকে তৈরি করা সুন্দর বসার স্থান, রান্নার জন্য চুলা, আমাদের মুক্তভাবে বিচরণের জন্য নদীর পাড় এবং আশপাশের কৃষিজমি, বটগাছ এবং সেগুলোতে কিচিরমিচির করা বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আমাদের মন কেড়ে নিয়েছিল। গ্রামবাসীর কথা না বললেই নয়। তাঁরা ছিলেন যথেষ্ট আন্তরিক।

সেখানে পৌঁছেই রান্নার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। খাবার হিসেবে খাসির মাংস, রোস্ট, চিংড়ি, মুগের ডাল ও সাদা ভাত রান্নার মূল দায়িত্ব বর্তায় আনিচের ঘাড়ে। খাবার প্রস্তুতে আনিচ যোগ্য সাগরেদ হিসেবে পাশে পায় পূজা, হুমায়ুন ও মনকে। তাদের একান্ত প্রচেষ্টায় যথাসময়ে খাবার প্রস্তুত হয়ে যায়।

খাবার রান্নার সময়ে ধীরে ধীরে চলে আসে বাকি বন্ধুরাও। নদীর পাড়ে তাদের হাসিঠাট্টায় ও কলরবে মুখর হয়ে যায় সাঁকোর ঘাট। বান্ধবীদের সবাই বাঙালি সাজ—লাল-নীল শাড়িতে আসায় শীতের মিষ্টি রোদে দারুণ আমেজ তৈরি হয়েছিল। সবার হৃষ্ট চেহারা দেখে মনের মধ্যে তখন এক স্বর্গীয় সুখ অনুভব করছিলাম। সুন্দর এই মুহূর্তগুলো ছবি ও ভিডিও করে রাখার কাজটি বেশ দারুণভাবেই করে শামীম ও রচি।

এবারে নদীর পাড়ে ঘাসের ওপর প্রাকৃতিক পরিবেশে বসে মধ্যাহ্নভোজের পালা। খাবার বণ্টনের দায়িত্ব পায় শাওন, মইনুল, সোহাগ ও কাইয়ুম। খাবার পরিবেশনে তারা ছিল করিতকর্মা। হৃদ্যতাপূর্ণ আবহে তারা সে দায়িত্ব সম্পন্ন করে। খাবারের বিষয়ে যেকোনো মন্তব্য কম হয়ে যাবে। আনিচের হাতের প্রতিটি ব্যঞ্জনই ছিল অমৃত! সবাই তৃপ্তি করে পেটপুরে খেয়েছি। খাবার শেষে ছিল মেয়েদের জন্য বল পাসিং, যেখানে প্রথম হয় সোহেলী তমা ও দ্বিতীয় হয় জয়ী প্রিয়া। ছেলেদের বাকেটে বল নিক্ষেপে একমাত্র বিজয়ী শাওন। খেলাধুলা শেষে সাংস্কৃতিক পর্ব মাতিয়ে রাখে তমা তিন্নি, লাবণ্য, আভা, রিতু ও সাথী।

ইতিমধ্যে ঘড়িতে সময় বিকেল চারটা। পূর্বাহ্ণ, মধ্যাহ্ন পেরিয়ে এখন অপরাহ্ণ! সুতরাং ফেরার পালা। সবাই যেন আরেকটু সময় অতিবাহিত করতে চাচ্ছিল। চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছিল, দিনটা যেন শেষ না হয়। কিন্তু আমাদের তো ফিরতে হবে, তাই ঘড়ির কাঁটার শাসন মেনে নিয়ে হাসিমাখা মুখে আনন্দঘন একটি দিনের ইতি টানি। শেষে একসঙ্গে বলে উঠি, আমরা থাকব স্নাতক শেষেরও পরে, স্থানকালের সীমারেখার ছাড়িয়ে, মন ও আত্মার মিলনে!  

লেখক: মো. রাসেল মিয়া, শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া