সব সমস্যার সমাধান কি কেবল একটি নির্বাচন
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার চ্যালেঞ্জিং কাজটিতে হাত দিয়েছেন নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর অদম্য সাহস ও মনোবল আছে বলেই তিনি চ্যালেঞ্জিং কাজটি সহজভাবে নিয়েছেন। দুর্নীতিগ্রস্ত ও অগণতান্ত্রিকভাবে ভেঙে পড়া একটা রাষ্ট্রকে গড়ে তোলার কাজে নেমে পড়েছেন। গঠন করেছেন বিভিন্ন সংস্কার কমিশন। গত তিনটা নির্বাচনে জনগণ যে ভোট দিতে পারেননি, সেই আক্ষেপ ও নির্বাচনের প্রতি মানুষের যে অনাস্থা, তা ফিরিয়ে আনতে গঠন করেছেন নির্বাচন সংস্কার কমিশন। অধ্যাপক ইউনূস জাতীর উদ্দেশে তাঁর প্রতিটা ভাষণে বলছেন, ‘আগে সংস্কার, তারপর নির্বাচন হবে।’
সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচনব্যবস্থাকে সমুন্নত করে জনগণের আস্থা ফেরানো হলে তিনি সুন্দর ও সুষ্ঠু একটা নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেবেন। কিন্তু সংস্কার কমিশনগুলো থেকে কোনো প্রতিবেদন আসার আগেই বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের বক্তব্য এবং বিবৃতি দেখে মনে হয়, অধ্যাপক ইউনূস আজীবনের জন্য ক্ষমতা দখল করে ফেলেছেন। রাজনীতিবিদদের এসব বক্তব্যের কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর জনগণের যে আস্থা রয়েছে, সেখানে ফাঁটল ধরতে শুরু করেছে।
বিএনপির প্রতিটা সমাবেশ থেকে শুনতে হয়, ‘নির্বাচন চাই নির্বাচন’! এমনকি কয়েক দিন আগে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন দীর্ঘদিন ধরে দেশ চলতে পারে না। বলেছেন, এই সরকার সংস্কারের নামে ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচনকে বিলম্ব করছে।’ এ বক্তব্য দ্বারা বোঝা যায়, বিএনপি সংস্কারব্যবস্থাকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে না। তারা সংস্কারব্যবস্থাকে সময় নষ্ট বলে অভিহিত করছে। অথচ, তাদের বোঝা উচিত, নির্বাচনের আগে যৌক্তিক সংস্কার সময়ের প্রয়োজনে। এ ছাড়া বিএনপির আরও অনেক নেতাকে এমন বক্তব্য দিতেও শুনেছি যে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার সংস্কার করতে পারে। কাজেই তারা সংস্কারবিহীন নির্বাচন চায়। আর সংস্কারবিহীন নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। সংস্কার ছাড়া একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় বসানো মানেই, নতুন ফ্যাসিবাদকে স্বাগত জানানো। তবে বিএনপি কি চায়, তারাও আওয়ামী লীগের মতো হয়ে ওঠতে?
যারা সংস্কারবিহীন নির্বাচন চায়, তাদের বোঝা উচিত, অন্তর্বর্তী সরকার কেন গঠিত হয়েছিল? কেবল একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে বিদায় নেওয়ার জন্য নয়। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুঁজি করে যে লুটপাট, গুম, খুন, ধর্ষণ ও দুর্নীতি করেছে, স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এভাবে কোনো গোষ্ঠী লুটপাট করেনি। গত তিনটা নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে যেভাবে ভোট থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক সংবিধান ব্যবস্থায় বৈধ হতে পারে না। আওয়ামী লীগ সরকারের এমন ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করার জন্য কেবল একটিই মাধ্যম ছিল, সেটি হলো সংস্কার। অন্তর্বর্তী সরকার সে পথেই হাঁটছে, কাজ করে যাচ্ছে। আর এই সংস্কারে কিছুটা সময় ব্যয় হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সমস্যা কোথায়? কথায় আছে ‘ধৈর্যের ফল সুমিষ্ট।’
শুধু তা–ই নয়! গত জুলাই অভ্যুত্থানে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড আওয়ামী লীগ চালিয়েছে, তা কোনো দিন আমরা ভুলতে পারি না। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের কথা ভুলতে পারি না। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার কি নির্বাচিত সরকার করবে? এমনিতেই গত ১৫ বছরে নির্যাতিত বিএনপি-জামায়াত বা আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষের রাজনীতিবিদদের দিকে তাকালে দেখতে পাই তারা এখন আওয়ামী লীগের প্রতি উদার হয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বারবার বলছেন, ‘আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে সুযোগ দেওয়া দরকার।’ মানে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির পছন্দের দল আওয়ামী লীগই। আর আওয়ামী লীগের পছন্দ বিএনপি।
আওয়ামী লীগ আমলে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত জামায়াতের দিকে তাকালে আজকাল অবাক হই। ৪ জানুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গাজীপুর সদর উপজেলার ভাওয়াল মির্জাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শফিকুল সিকদার (৩৮) পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলে তাঁকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় মিছিল নিয়ে হাজির হয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। পরে তাঁরা থানা ঘেরাও করেন বলেও জানা যায়। মানে, যেসব রাজনীতিবিদেরা আওয়ামী লীগের আমলে সবচেয়ে বেশি শোষিত হয়েছিলেন, তাঁরাও এখন আওয়ামী লীগের জন্য সহানুভূতিশীল হয়ে আছেন। আসামিদেরকে গ্রেপ্তার করা হলেও থানা ঘেরাও কিংবা মানববন্ধনের মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে।
এখনো কোনো নির্বাচিত দল ক্ষমতায় আসেনি, তবুও রাজনীতিবিদেরা তাঁদের রাজনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে আসামিদের জামিনের জন্য জোর খাটাচ্ছেন। তাহলে আমরা কীভাবে মেনে নিতে পারি যে সংস্কারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে একটা রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় নিয়ে এলে তাঁরা আওয়ামী লীগের বিচার করবেন?
সংস্কার ছাড়া একটা নির্বাচন দিয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। আওয়ামী লীগের আমলে এস আলমের দ্বারা ব্যাংক ডাকাতি, এমপি-মন্ত্রীদের টাকা পাচার, উন্নয়নের নামে দুর্নীতি, শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার, বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও গুম-খুন-ধর্ষণের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যৌক্তিকতা হতে পারে না। আর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার বা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্যই তো দরকার নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার। এ জন্য বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করা।
লেখা: আবদুল্লাহ নাজিম আল মামুন, শিক্ষার্থী