বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি কবে চালু হবে
কথায় আছে, অভাগা যেদিকে তাকায়, সাগরও শুকিয়ে যায়। কথাটি যেন বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য প্রযোজ্য। বলা হয়ে থাকে, মহান পেশা শিক্ষকতা। কিন্তু পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। দুর্ভাগ্য যেন বেসরকারি শিক্ষকদের পিছু ছাড়ছে না। বেসরকারি শিক্ষকেরা মহান পেশায় নয়, যেন মহাপাপ করে বসে আছেন। ভাগ্যবিধাতাও শিক্ষকদের সঙ্গে যেন নেই। শিক্ষকদের নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে কাউকে দেখি না। সেটা আর্থিক হোক কিংবা অনার্থিক হোক। শিক্ষকদের বেতন ভালো নেই। নামমাত্র উৎসব ভাতা। এক হাজার টাকা ঘরভাড়া। পাঁচ শ টাকা চিকিৎসা ভাতা। শিক্ষা ভাতা নেই। বদলি নেই। নেই আর নেই। আশার আলো দেখছিলেন শিক্ষকেরা, অন্তত বদলি হতে পারবে। বদলি হয়ে পরিবার–পরিজন নিয়ে ডাল–ভাত খেয়ে জীবন কাটিয়ে দেবেন। বদলি অনার্থিক বিষয় ছিল। কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে গলে। তীরে এসে স্থগিত হলো বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি প্রক্রিয়া।
বদলি এমন একটি প্রক্রিয়া, যা চালু করলে সরকারের কোনো টাকা খরচ হবে না। সব শিক্ষকের বদলি জটিল মনে হলে ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের আলাদা গণবিজ্ঞপ্তি হতে পারে সমাধান। আলাদা গণবিজ্ঞপ্তির ফলে সরকারের কোষাগারে কিছু টাকাও জমা হতে পারে।
৫ মে আরেকটি কালো অধ্যায় রচিত হলো। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য। যেখানে শিক্ষকেরা আনন্দ-উল্লাসের দিন ছিল। সেখানে দিনটি বিষাদে পরিণত হলো। শুধু কি বেদনা? যাকে বলে বেদনার বিষে একেবারে নীল হতে হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির জন্য কর্মশালার পর কর্মশালা হলো। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন হবে, ঠিক শেষ মুহূর্তে বাধাপ্রাপ্ত হলো। তাঁরা বললেন, বদলি জটিল প্রক্রিয়া। তা হলে এত দিন কর্মশালায় এই জটিলতা ধরা পড়ল না কেন! এই জটিলতার কথা কর্মকর্তারা বলেননি কেন? বেসরকারি শিক্ষকেরা আবার তামাশার পাত্র হলেন রাষ্ট্রীয়ভাবে। আমরা শিক্ষকেরা এ–ও বলেছি, যদি আপনারা বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি জটিল মনে করেন, তা হলে সব ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের আলাদা গণবিজ্ঞপ্তি দেন। আবার এনটিআরসিএ নিয়োগে ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের আবেদন বন্ধ করলেন।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বদলি হোক সর্বজনীন, সবার জন্য সমান সুযোগ রেখে। কেউ বদলির সুযোগ পাবেন, কেউ পাবেন না, এমন নীতিমালা যেন না হয়। বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি চালু মৃত প্রাণে জীবনদান। কিন্তু এ বদলি হোক সব শিক্ষকের জন্য। শিক্ষকেরা যেন আর কোনো হতাশায় না ভোগেন। নতুন করে যেন কোনো বৈষম্যের সৃষ্টি না হয়। ইতিমধ্যে মাদ্রাসায় অধিদপ্তর সব ইনডেক্সধারী শিক্ষকের বদলি উদ্যোগ নিয়েছে, যা প্রশংসনীয়। এ খসড়ায় কোনো বৈষম্য রাখা হয়নি। সবার জন্য সমান সুযোগ রাখা হয়েছে। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে যেন সব ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের জন্য সমান সুযোগ রাখা হয়।
এনটিআরসিএর যাত্রা শুরুর আগে ১৯৯৫ সালের নীতিমালায় শিক্ষকদের বদলি চালুর কথা বলা হলেও আজও সেটা আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তী সময়ে সব নীতিমালা ও শিক্ষা আইনে এমনকি হাইকোর্টের নির্দেশে ও বেসরকারি সব শিক্ষকের বদলির কথা বলা হয়েছে। যা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। এরপরও সব শিক্ষকের বদলি চালু না করে এনটিআরসিএর শিক্ষকদের বদলি প্রাধান্য কেন। এনটিআরসিএ সুপারিশ করলেও ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হয়েছে। তা হলে কী দাঁড়াল—সবশেষে কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ হতে হয়েছে। এখানে কমিটি, সনদপ্রাপ্ত এবং এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্ত না দেখে সব ইনডেক্সধারী শিক্ষকের বদলি চালু হোক।
জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১-এ একীভূত শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। একীভূত শিক্ষা হচ্ছে একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে ধর্ম-বর্ণ, ধনী-গরিব, ছেলেমেয়ে, প্রতিবন্ধী-অপ্রতিবন্ধীসহ সব শিশুকে একই শিক্ষক দ্বারা, একই পরিবেশে একসঙ্গে মানসম্মত শিক্ষাদান করা হয়। আমরা শিক্ষকেরা শিখন অর্জন করছি দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ। কিন্তু শিক্ষকদের ক্ষেত্রে বৈষম্য ও বিভাজন কেন। শিক্ষকেরা একে অপরের সহযোগিতায় শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন সম্ভব। কিন্তু প্রতিযোগিতা কেন? এখানে সব শিক্ষকের পরিচয় শিক্ষক। কে কীভাবে শিক্ষকতা পেশায় আসছেন সেটা বড় নয়। এখানে সবার পরিচয় ইনডেক্সধারী শিক্ষক। সবাই সমান সুযোগ পাবেন।
বদলি এমন একটি প্রক্রিয়া, যা চালু করলে সরকারের কোনো টাকা খরচ হবে না। সব শিক্ষকের বদলি জটিল মনে হলে ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের আলাদা গণবিজ্ঞপ্তি হতে পারে সমাধান। আলাদা গণবিজ্ঞপ্তির ফলে সরকারের কোষাগারে কিছু টাকাও জমা হতে পারে। তাই বলব জটিল কিছুই না। তাই বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। স্মার্ট ও ডিজিটাল বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই। সব তথ্য এখন হাতের মুঠোয়। তাই বলব, সব শিক্ষকের বদলি চালু করতে আন্তরিকতা ও সদিচ্ছাই যথেষ্ট।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা সমস্যায় জর্জরিত। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে সুযোগ–সুবিধা আকাশ-পাতাল পার্থক্য। বেতনেও সরকারি–বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে পার্থক্য। বাড়িভাড়ায় পার্থক্য। ঈদ বোনাসে পার্থক্য। বদলির ক্ষেত্রে পার্থক্য। শুধু পার্থক্য আর পার্থক্য। এখন আবার বদলি নীতিমালায় যদি বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয়, তাহলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জটিল থেকে জটিলতর বৈষম্য তৈরি হবে। যা শিক্ষায় স্পষ্ট প্রভাব পড়বে বলে মনে হয়। শিক্ষায় সমাধান হোক সর্বজনীন বদলি চালু।
শিক্ষায় বৈষম্য কাম্য নয়। যা কিনা রাষ্ট্র–সমাজে প্রভাব ফেলে। শিক্ষায় সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসনের কাজ চলছে। সেখানে শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা বৈষম্য নিরসন করে সব শিক্ষকের বদলি নীতিমালা হবে। এমনটাই প্রত্যাশা করি। একটি গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট নয়, সব শিক্ষককে সন্তুষ্ট করে যেন নীতিমালা হয়। বদলি চালু সব শিক্ষকের অধিকার।
*লেখক: মো. আবু তাহের মিয়া, সহকারী শিক্ষক, তাড়ল উচ্চবিদ্যালয়, দিরাই, সুনামগঞ্জ
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]