পরিচিত মুখ
খাবার টেবিলে বসে আছি। আম্মা ভাত বেড়ে দিল। পাতে ইলিশ আর কুমড়োর তরকারি তুলে দিল। আমি ভাত নেড়ে নেড়ে দেখছি। আম্মা মেঝেতে বসে শসা কাটছে আর বলছে, রাফিন, মেয়েটা খুব ভালোই ছিল রে। কেন যে এমন হলো! আমি গ্লাস নিয়ে পানি খাচ্ছি। গ্লাস মুখের ওপর ধরে রেখেছি।
গ্লাস নামিয়ে এ প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য আম্মাকে বললাম, আম্মা, ইলিশ মাছের তরকারিটা খুব স্বাদ হয়েছে। কত দিন থেকে যে খেতে ইচ্ছে করছিল!
আম্মা সামান্য হাসলেন। তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। বললেন, তুই তো ইলিশ মাছ দেখতেই পারিস না। ইলিশ মাছের গন্ধও তো সহ্য করতে পারিস না। ইলিশ মাছের গন্ধ শুনলে তুই দুই মাইল দূরে থাকিস। তোর আবার ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে করে?
আম্মার কথা একদম ঠিক, আসলেই ইলিশ মাছ পছন্দ করি না। কোনো বাড়িতে ইলিশ মাছ রান্না হলে আমি দূর থেকে বলে দিতে পারতাম ওই বাড়িতে আজ ইলিশ মাছ রান্না হচ্ছে।
আমি অন্যদিকে ফিরে বললাম, না আম্মা। আমি এখন অনেক কিছুই সহ্য করতে পারি। আমার সহ্যের সীমা এখন অনেক দূর।
আম্মা সালাদ দিতে এল। আমি পাতে পানি ঢেলে উঠে পড়লাম।
কী রে বাপধন, ভাত খাবি না? মাছটাও তো শেষ করলি না। কই যাস?
আমি বেসিনে হাত ধুতে এলাম। আমার রুমের দরজার ঠিক বাঁ দিকে বেসিন। বেসিনে একটা আয়না ঝোলানো। আয়নার এক পাশ ভাঙা। মাঝখানে বড় করে একটা ফাটা দাগ পড়েছে। আমার অর্ধেক চেহারা দেখা যাচ্ছে আর বাকি অর্ধেক বড় বড় লাগছে। আমি কল ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছি। হাত ধুব, ঠিক তখনই আমার চোখ পড়ল ভাঙা আয়নায়। এ কী, আমি দেখি কাঁদছি। দুচোখ ভর্তি জল। গাল বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। অথচ কান্নার কোনো শব্দ হচ্ছে না। পুরুষেরা কি এমনই? হাজারো ব্যথা বুকের মধ্যে লুকিয়ে মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখে?
আমি রুমে এলাম। খাটে বসলাম। বালিশের পাশ থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা নিলাম। খুব বেশি একটা ধূমপান করি না। বন্ধুদের সঙ্গে নদীর পাড়ে বসলে মাঝেমধ্যে দুয়েক টান দিই। বন্ধুরা বলে রাফিন, ধোঁয়া খেলে দুঃখ-কষ্ট দূর হয়। আমার কাছে ফালতু বাতচিত মনে হয়। আমি বলি, গাঁজাখুরি কথা কই পেয়েছিস? ওরা আমার কথা শুনে শূন্যে ধোঁয়া ছেড়ে হাসে। আকাশে ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকাতে পাকাতে উড়ে যায়। দূরে কোথাও। আমি আর আগের মতো বন্ধুদের সঙ্গে খুব বেশি একটা মিশি না। মিশতে ইচ্ছে করে না। একাকী থাকি। একা একা কথা বলি, নিজের সঙ্গে কিংবা প্রকৃতির সঙ্গে।
দেশলাইয়ের বক্স খুঁজে পাচ্ছি না। বাবা হয়তো নিয়েছেন। মাঝেমধ্যে বাবা এসে দুয়েকটা সিগারেটও নিয়ে যান। বাবা কী জেনে গেছেন, আমি সিগারেট খাই? ওই ঘটনার পর থেকে বাবাও কেমন যেন নীরব হয়ে গেছেন। মন চাইলে অফিসে যান, না চাইলে নেই। উত্তরা ৪ নম্বরে সেক্টরে বসে চা-ওয়ালাদের সঙ্গে বসে গল্পগুজব করেন। পেপার পড়ে সময় কাটান। ছুটির দিনগুলোতে বাবা বারান্দায় ইজি চেয়ারে মন খারাপ করে বসে থাকেন। বাবাকে দেখলে আমার বড্ড মন খারাপ হয়। আমার জন্য আমার পরিবার কষ্ট পাবে কেন? আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না।
তুলি। আমার ছোট বোন। সে ওর রুমে শব্দ করে পড়ছে। নতুন ম্যাম আসার পর থেকে এই অবস্থা। এই ভরদুপুরে শব্দ করে পড়ার কী আছে কে জানে। একদিন ম্যামকে কড়া করে দুয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে হবে।
মুখ থেকে সিগারেট নামিয়ে চিৎকার করে ডাকলাম,
তুলি, এই তুলি?
ভাইয়া, বলো।
এই রুমে আয়।
ম্যাম এসেছে। পড়ছি। আমি এখন যেতে পারব না।
কেন?
ম্যাম বাসায় এলে আমার সব কাজ বন্ধ।
তুই আসতে না পারলে তোর ম্যামকে পাঠা। যত্তসব ফাউল মেয়েছেলে কোথাকার। রান্নাঘরে দেশলাই আছে না? নিয়ে আয়।
আমি রাগ করে সিগারেটটা দরজার দিকে ছুড়ে ফেললাম। ম্যাম ঠিক সেই মুহূর্তে দরজা দাঁড়িয়ে দেশলাই বাড়িয়ে দিলেন।
এই নিন দেশলাইয়ের বক্স।
আমি বললাম, না। লাগবে না।
আপনি তুলিকে না বললেন আমাকে দেশলাইয়ের প্যাকেট নিয়ে আসতে?
হ্যাঁ, বলেছি। কিন্তু...
রাফিনের খুব খারাপ লাগছে। কঠিন কঠিন কথা বলতে ইচ্ছে করছে। মনে মনে অনেক চেষ্টাও করল কিন্তু কোনো কঠিন কথা তার মুখ দিয়ে বের হলো না।
মেয়েটি রুমে হেঁটে হেঁটে দেখছে। মনে হচ্ছে তার পূর্বপরিচিত একটা ঘর। যেই ঘরে হারানো স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সে তা নিচ্ছে।
এটা আপনার ঘর? ঘরটা তো খুব সুন্দর। এত সুন্দর করে কে সাজিয়ে রেখেছে? আপনার বউ? আমাদের ভাবি? উনি কোথায়? একটু কথা বলি। চা-টা খেয়ে আজ চলে যাব। আজ আর তুলিকে পড়াব না।
কী, চলে যাব? একবার বসতেও তো বললেন না। আপনি বিরক্ত হলে উঠি। অন্য একদিন আসব?
রাফিন কথার কথা বলল, আরে না, বসুন। শেফালীকে চা দিতে বলি?
ও ঘুমোচ্ছে পাশের ঘরে। দেখে এলাম। এখন চা খেতে ইচ্ছে করছে না। তার চেয়ে বরং আজ আপনার সঙ্গে একটু গল্পটল্প করি।
রাফিন কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মেয়েটা কী মনে করে যেন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে বলল, এই ছবিটা কার? আমার খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। মেয়েটি কে? কী নাম তার?
*লেখক: মনজুর সা’দ, কসবা, শেরপুর
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]