বৈষম্যহীন মৃত্যুপুরী
একটু আগেই সোহেল মারা গেল। মারা যাওয়ার আগে খুব কষ্ট হচ্ছিল। অক্সিজেনের অভাব খুব টের পাচ্ছিল। চোখ বুজে আসছিল বারবার, তারপরও চোখ টেনে খোলা রাখার চেষ্টা করছিল বন্ধুদের মুখগুলো দেখার জন্য কিন্তু মুখগুলো ক্রমশ ঘোলা হয়ে যাচ্ছিল। শিফাতের সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করছিল খুব কিন্তু মুখ নাড়াতে পারছিল না। মুখ দিয়ে শুধু লালা বের হচ্ছিল। ছোটবেলায়ও নাকি ওর এ রকম লালা পড়ত। গরিব ঘরে জন্ম। সবাই বলত, পেটে থাকতে মায়ের খাওয়ার ইচ্ছে পূরণ না হলে নাকি এমন হয়।
সে যাই হোক, মারা যাওয়ার সময় পানিও খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল ওর। কে একজন পানি দিয়েছিলও মনে হয় কিন্তু মুখ এত শুকনো ছিল যে গলা পর্যন্ত পৌঁছায়নি। মরার সময় পানি না পেলেও জন্মের সময় কিন্তু মুখে মধু দিয়েছিল ওর দাদিজান। গরিব হলেও মধু জোগাড় করে রেখেছিল ওর দাদি। ওর দাদার নাকি মুখ খুব খারাপ ছিল, তাই ওর মুখ দিয়ে যাতে মিষ্টি কথা বের হয়, সে জন্য এই চেষ্টা। কিন্তু মিষ্টি কথা তো কখনো বের হয়নি, হলে তো গান করতে পারত, শিল্পী হতো। বরং উল্টোটা হয়েছে—গলা হয়েছে কর্কশ আর চড়া। মিছিলে, স্লোগানে নাকি ওর গলা খুব জোরালো হয়। তেজ আসে ওর স্লোগানে। আজ ওর স্লোগানের আরও বেশি তেজ ছিল, যখন ও আহত হয়ে হাসপাতাল যাচ্ছিল, তখন সবাই বলাবলি করছিল সে কথা। সবাই বলেছিল—তুই বেঁচে যাবি, কিচ্ছু হবে না তোর। তোর কিছু হলে স্লোগান দেবে কে? আন্দোলনের কী হবে! আসলে এগুলো শোনার অবস্থা ছিল না ওর, কিন্তু শুনতে খুব ভালো লাগছিল।
সোহেল মারা গেছে প্রায় এক ঘণ্টা হলো কিন্তু কেউ টের পায়নি। সবাই ভাবছিল ঘুমাচ্ছে। সোহেল মনে মনে হাসছিল, বুকে গুলি লাগলে কেউ কি ঘুমায় রে? আসলে আন্দোলনটা ন্যায্য ছিল, তাই ডাক্তারদের ওপর কড়া নির্দেশ, যেন আন্দোলনকারীদের প্রশ্রয় না দেওয়া হয়। ঘণ্টাখানেক পরে ডাক্তার এসে ওকে দেখেই নিশ্চিত হয়েছিল ও মারা গিয়েছে, তবুও হাতটা ধরে নাড়ি দেখে বলে মারা গিয়েছে। ডাক্তার যখন ওর নাড়ির স্পন্দন দেখছিল, তখনো কিন্তু ওর রক্তের মধ্যে স্লোগান চলছিল ডাক্তার হয়তো বুঝতে পারেনি। তাই ওকে মৃত ঘোষণা করে দিল। আসলে মৃতের রক্তে কিসের স্লোগান চলে, সেটা ডাক্তার কীভাবে বুঝবে!
একজীবনের ল্যাঠা চুকিয়ে সোহেল আরেক জীবনের দিকে মনোযোগ দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ মনে করল। তাই আত্মীয়স্বজন–বন্ধুবান্ধবের কান্নাকাটি উপেক্ষা করে মৃতজীবনের প্রতি মনোযোগী হলো।
মারা যাওয়ার পরে পরেই সোহেলের কাছে একজন এসে নাম টুকে নিয়ে গেছে। যে নাম টুকে নিয়ে গেছে সে কে, তার নাম কী, পদবিই বা কী সোহেল কিছুই জানে না। শুধু নাম টোকার সময় বলে দিয়েছিল তোমার তিন দিনের ছুটি। মন খারাপ তাই সেদিন জিজ্ঞেস করেনি কিসের ছুটি। তবে তিন দিন সময় খুব দ্রুত চলে গেল।
তিন দিন পরে এসে সোহেল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। পৃথিবীর মানুষের কয়েক হাজার গুণ বেশি মানুষ এখানে। তবে সোহেলের বিশ্বাস এখানে কোনো বৈষম্য নেই পৃথিবীর মতো। বৈষম্য দূর করার আন্দোলন করতে গিয়েই তো আজ ওকে অকালে আসতে হলো এখানে। ঈশ্বর নিজেই এখানে সব বিষয় দেখেন। একজনের সঙ্গে এর মধ্যেই পরিচয় হয়েছে সোহেলের। খুব ভালো ছেলে, ওর বয়সী। সে সোহলকে নিয়ে গেল হাজিরা রুমে। তালিকা খুঁজে সোহেলের নাম বের করল।
তালিকা করা লোকটা জিজ্ঞেস করল—কীভাবে মারা গেলেন?
সোহেল হেসে জবাব দিল—সেটা তো আপনারা ভালো জানেন। আপনি তো ঈশ্বরের লোক। সবকিছু ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই তো হয়!
এই উত্তরে যে লোকটা বিরক্ত হয়েছে, সেটা বেশ বুঝতে পারল সোহেল।
সিরিয়াল নম্বর নিয়ে সোহেল লাইনে এসে দাঁড়াল। বিশাল লম্বা লাইন। কত মানুষ যে প্রতিদিন মারা যায়, এখানে এসে ও তা বুঝতে পারল। তবে বেশির ভাগই বুড়ো–বুড়ি। সোহেলেরও স্বপ্ন ছিল বুড়ো হয়ে মরার। তাসনিমও ওর সঙ্গে বুড়ি হবে। ওরা একসঙ্গে বা কিছুদিন আগে–পিছে স্বাভাবিকভাবে মরবে।
সোহেলের খুব আফসোস তাসনিমকে দেওয়া কোনো কথা রাখতে পারল না। শাড়ি পরা তাসনিমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওর কোমর জড়িয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরবে আর তাসনিম ওর গলা জড়িয়ে মুখ উঁচু করে সোহেলের দিকে তাকাবে। আর ও তাসনিমকে কানে কানে ফিসফিস করে বলবে—তোকে অনেক ভালোবাসি। স্বপ্নই থেকে গেল সেটা...
একটা হট্টগোলের শব্দে সোহেল বাস্তবে ফিরে এল। মৃত্যুপুরীই এখন ওর বাস্তবতা। কী নিয়ে যেন হইচই হচ্ছে। সোহেল এগিয়ে গেল।
কেউ একজন খুব খেপে গিয়েছে। তার দাবি, সে ভালো কিছু না করলেও তার বাপ–দাদা খুব ভালো ছিল।
তারা ঈশ্বরের রাস্তায় ছিল, নিজের জীবন ঈশ্বরের জন্য বাজি রেখেছে, তাহলে সে কেন অন্যদের চেয়ে একটু বেশি সুবিধা পাবে না। কিন্তু এ কথা ঈশ্বরের প্রতিনিধি শুনতে নারাজ। তার বক্তব্য, যার যার কর্মফল সে ভোগ করবে। আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী আপনার বরাদ্দ ঠিক করা হবে। আপনার দাদাকে দেখেছেন সে কোথায় আছে? সে এখানে সবচেয়ে সম্মানিত স্থানেই আছেন, কারণ তার ত্যাগে ঈশ্বর খুশি।
আপনাকে আপনার যোগ্যতার বাইরে আমরা কিছু দিতে পারব না। এখানে বৈষম্যের কোনো স্থান নেই।
কিন্তু লোকটা কোনোভাবেই এটা মানবে না। তার এক কথা, তার বাপ–দাদার কাজের মূল্যায়ন কোথায়! লোকটার সঙ্গে আরও কিছু আবাল যোগ দিয়েছে, তাদেরও নাকি দাদার বাবা ঈশ্বরসেবা করেছে; তাই তারাও কিছু সুবিধা চায়। কিন্তু ঈশ্বরের প্রতিনিধি একচুলও ছাড় দেবে না জানিয়ে দিয়েছে। তাই ওরা হট্টগোল করছে।
সোহেল মৃদু হেসে নিজের লাইনে ফিরে এল আর আফসোস করল পৃথিবীতে ঈশ্বরের এমন প্রতিনিধি থাকলে ওকে মিছিলে যেতে হতো না, স্লোগান তুলতে হতো না গলায়, বুকে সরকারি বুলেটটাও বিঁধে থাকত না। তাসনিম আর ও একসঙ্গে বুড়ো হতো পারত ভালোবেসে। ভাবতে ভাবতে একটু অশ্রু গড়িয়ে পড়ল মনে হয় সোহেলের চোখ দিয়ে। জীবনের প্রতি মায়া খুব টের পাচ্ছে মরে গিয়ে।
*নাগরিক সংবাদ-এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]