হাট না অ্যাগ্রো: কোরবানি না শো অফ
পবিত্র কোরবানির মৌসুম এলেই শহরের বাতাসে পশুর গন্ধের সঙ্গে মিশে যায় একধরনের প্রতিযোগিতার উত্তাপ। কে কত বড় গরু কিনছেন, কার পশুর দাম কত, কে কোন অ্যাগ্রো থেকে কিনছেন—এসব প্রশ্ন যেন উৎসবের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মীয় আবেগ, আত্মত্যাগের শিক্ষা ও সামাজিক সহমর্মিতার জায়গায় আজ জায়গা করে নিচ্ছে ‘শো অফ’—একটি শব্দ, যা ধীরে ধীরে আমাদের কোরবানির সংস্কৃতিকে গ্রাস করছে।
হাটে হাঁটার চেয়ে এখন অনেকের বেশি আগ্রহ অ্যাগ্রো ফার্মের ফেসবুক পেজে চোখ রাখা। কত বড় বড় নাম। অ্যাগ্রো ফার্ম এখন যেন কোরবানির হাটের নতুন কেন্দ্রবিন্দু। তাদের গরুগুলো পায় ডিজিটাল পরিচর্যা, রঙিন পোশাক, ফ্যান্সি নাম আর ভাইরাল পোস্ট। এ যেন ‘বংশমর্যাদাসম্পন্ন’ পশুর জমকালো র্যাম্প শো।
গত বছর কোটি টাকার বংশমর্যাদাপূর্ণ এক গরু নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় উঠেছিল। আর সেই ১৫ লাখ টাকার ছাগল যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল মালিকের সো কল্ড সোশ্যাল স্ট্যাটাস (!)। এসব দেখে প্রশ্ন জাগে, ‘আমরা কি আসলেই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি দিচ্ছি, নাকি সমাজে নিজের অবস্থান জানানোর জন্য?’
নাগরিক সংবাদ–এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]
একটা সময় ছিল, যখন মানুষ হাটে গিয়ে গরু কিনতেন, দরদাম করতেন, চোখের দেখায় পছন্দ করতেন। এখন সেটি বদলে গেছে। অনেকেই ফেসবুক লাইভ দেখে অর্ডার করেন; সঙ্গে লাইভ ওয়েটে পশু ক্রয় তো আছেই। ওজনের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অ্যাগ্রো যদি পশু দিতে না পারে, সেই পশু ফেরতও দেওয়া হয়! পশু নয়, আমরা যেন অর্ডার দিচ্ছি ‘প্রতিপত্তির’, যার মাধ্যমে আমরা কি জানান দিচ্ছি, ‘আমিও পারি?’ কোথায় গেল আমাদের ধর্মীয় আবেগ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন?
হাটের একটি গরু হয়তো গ্রামের ছোট ছেলের হাত ধরে বড় হয়েছে, কিন্তু অ্যাগ্রোর গরু বড় হয় ভিডিও ক্যামেরার সামনে, প্রিমিয়াম খাবারে ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষায়। তাতে পশুর যত্ন হয় ঠিকই, কিন্তু সম্পর্ক আর গ্রামের গরুটার মতো মালিকের বা তাঁর ছেলের সঙ্গে গড়ে ওঠে না। সম্পর্ক তৈরি হয় মানুষের মধ্যে—কে কত দাম দিলেন, কে কত ভাইরাল হলেন, কে কোন সেলিব্রিটির মতো গরু কিনলেন। এ ছাড়া কেনার পর ফেসবুকে লাইভ সোল্ড পোস্ট তো আছেই! সব জায়গায় সেলফি ও ফেসবুকে আলহামদুলিল্লাহ ডান পোস্ট তো আছেই। তাতে আবার দামটাও অনেকে মেনশন করে দেন।
তা ছাড়া ভাইরাল হওয়ার নেশায় প্রান্তিক খামারিদের সাধ্যের অতিরিক্ত বড় গরু পালাও নেশায় পরিণত হয়েছে। বেশি লাভের আশায় শহরের হাটে আসেন। পরবর্তী সময়ে চোখের পানি নাকের পানি এক করে ইউটিউবারদের ভিউ ব্যবসা বাড়িয়ে অনেক কম দামে তা বিক্রি করে দেওয়ার অসংখ্য নজির অনলাইনে আছে।
এই গোটা প্রক্রিয়ায় হারিয়ে যায় কোরবানির মূল শিক্ষা—আত্মত্যাগ। কিন্তু আমরা কি কিছু ত্যাগ করছি? নাকি শুধু টাকার জোরে পশু কেনা আর ‘মিডিয়া রিচ’ হওয়ার লড়াইয়ে নেমে পড়েছি?
হাট হোক বা অ্যাগ্রো, আমাদের মনে রাখতে হবে, কোরবানি কোনো প্রদর্শনীর বিষয় নয়। এটি একটি আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের ভেতরের অহংকার, লোভ আর মোহকে কোরবানি করি। পশু কোরবানির বাইরেও আমাদের প্রয়োজন ভেতরের ‘নফস’ কোরবানি দেওয়া।
সুতরাং প্রশ্ন হলো, আমরা কী কোরবানি দিচ্ছি? নিজের মনের পশুত্ব, নাকি শুধু টাকার অঙ্কে গড়া এক সামাজিক স্ট্যাটাস? নাকি সবই ভাইরাল হওয়ার ধান্দা?
আব্দুল্লাহ মুহসিন
শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়