আড়ালে রয়ে যাওয়া ফুলপরীদের কী হবে
মানুষ যখন সফল হয়, তখন সব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। যদি সফল না হয়, তাহলে তার কথা কেউ মনে রাখে না। গত ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে রাতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় ধরে অত্যাচার ও নির্যাতন চলে নবীন ছাত্রী ফুলপরীর ওপর। গণমাধ্যমের কল্যাণে সে ঘটনা সবার সামনে আসে এবং একপর্যায়ে হাইকোর্টের নজরে পড়ে। হাইকোর্টের নির্দেশমতো তদন্ত হয়। এ ছাড়া হল প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ছাত্রলীগের তদন্ত কমিটিও তদন্ত করে। তদন্ত শেষে হাইকোর্ট সে রাতে নির্যাতনকারী পাঁচ শিক্ষার্থীকে অস্থায়ী বহিষ্কার করতে নির্দেশ দেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এটুকু স্বস্তি এসেছে যে বিচার হয়েছে। হাজারো বিচারহীন ঘটনার মধ্যে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে তবু একটা ঘটনার বিচার হলো।
কিন্তু প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা তাঁদের ওপর হওয়া অন্যায়ের বিচার পাচ্ছেন না। অনেক সময় তো উল্টো ভুক্তভোগীকেই দোষ দেওয়া হয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েই কয়েক মাস আগে বিভিন্ন সময় কয়েকবার সিনিয়র শিক্ষার্থীরা জুনিয়র শিক্ষার্থীদের কাছে নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কোনোটারই বিচার তো পরের বিষয়, সুষ্ঠু তদন্তই হয়নি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ২০২১ সালের অক্টোবর মাসের একটি ঘটনা বেশ আলোচনার সৃষ্টি করেছিল। তখন এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। তাঁর মাথায় সাদা ব্যান্ডেজে লেখা ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না’ ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
সংবাদমাধ্যমে দেখলাম, গত ২২ ফেব্রুয়ারি দলীয় কর্মসূচিতে না যাওয়ায় রাজশাহী কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে ৩০ ছাত্রকে পিটিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তাঁদের মধ্যে দুজন সংবাদকর্মীও ছিলেন। ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যোগ না দেওয়ায় সন্ধ্যার পর থেকে ছাত্রাবাসের কক্ষে কক্ষে গিয়ে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। ২১ ফেব্রুয়ারি ইডেন কলেজে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে শিক্ষার্থীকে আহত করেন এক ছাত্রলীগ নেত্রী।
এর মধ্যে একটা হাস্যকর বিষয় ঘটে গেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের পর শিবির বলে চালিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। কৃষ্ণ রায় নামের ওই ছাত্রকে হলের কক্ষে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ২০২২ সালে ২০টি ঘটনায় মোট ২৭ জন শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দ্বারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে এক সমীক্ষার তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ পরিচালিত ‘স্টুডেন্টস এগেন্সট টর্চার-স্যাট’ নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংগঠন। এর মধ্যে চারটি ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো
আমি যখন প্রথম বর্ষে ছিলাম, তখন প্রথম দিকে আমার বেশ কয়েকজন বান্ধবী সব সময় কেমন যেন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকত। কারণ জিজ্ঞাসা করলে একদিন বলল, কোনো একজন তথাকথিত নেতা তাঁর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক করতে চান। না চাইলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার পর এ ঘটনা নিয়ম করে ঘটে। এটা শুধু যে ওই এক-দুজনের সঙ্গে হয়, তা নয়। অধিকাংশ ছাত্রীর সঙ্গেই ঘটে। তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে এসব ঘটনা। ফুলপরীর সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের কথা হয়তো সামনে এসেছে, কিন্তু এমন হাজারো ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে, যার হদিসও কেউ পায় না।
বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসের অন্যতম স্তম্ভ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। দেশের সব আন্দোলন-সংগ্রামে যারা মুখ্য নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে সব সময়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এরশাদবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত সময়টা এ দেশের ছাত্ররাজনীতির স্বর্ণযুগ। ছাত্ররা তখন সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত। কিন্তু বর্তমান সময়ে তা আর দেখা যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো সব সময় দেশের ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এটা যেন একটা অলিখিত নিয়ম। আর হলগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ছাত্রনেতারা প্রতিষ্ঠা করে একনায়কতন্ত্র। যদিওবা বলা হয়, হলের সিট কে পাবে, তা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঠিক করে দেয়, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
যখন বিএনপি সরকারের আমলে ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবির প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, সাধারণ ছাত্ররা টুঁ শব্দটি করতে পারতেন না। ছাত্রশিবিরের নিয়ন্ত্রণাধীন হলগুলোতে ভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থীদের থাকতে আলাদা টাকা দিতে হতো। অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থীর জীবন নষ্ট করে দিয়েছে তারা। সেসব অপরাধের বিচারও হয়নি।
বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার পর মনে হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ ফিরবে। কিন্তু গত কয়েক মাসের বিভিন্ন ঘটনা ওই ধারণা পরিবর্তন করে দিচ্ছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী নিম্নবিত্ত পরিবারের। কারণ, বর্তমান সময়ে টাকা থাকলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। নিম্নবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়েরা তাঁদের সন্তানকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান অনেক স্বপ্ন নিয়ে। বুকে আশা থাকে তাঁদের ছেলেমেয়েরা ভালোভাবে পড়াশোনা করে সংসারের হাল ধরবে।
পরিবারের দুঃখের দিন শেষ হবে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফুলপরীর বাবা ভ্যানচালক। এমন অনেক শিক্ষার্থী আছেন, যাঁদের বাবা কৃষক, শ্রমিক। তাঁরা অনেক কষ্ট করেন, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সন্তান মানুষ করেন। এমন অনেক শিক্ষার্থী আছেন, যাঁরা টিউশনি করিয়ে নিজের খরচ চালান এবং বাড়িতেও টাকা পাঠান। এমন একটা ছেলে বা মেয়েকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে যখন মেরে ফেলা হয় বা তাঁর ক্ষতি করা হয়, তখন পুরো পরিবারটা শেষ হয়ে যায়।
এমন একটা শিক্ষার্থীর ওপর যখন নির্যাতন হয়, কিংবা তাঁদের থেকে টাকা কেড়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে, এটা অপরাধের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যায়। আর এ কাজ করার পর অপরাধীদের যাঁরা প্রশ্রয় দেন তাঁরা আরও বড় অপরাধী।
বিশ্বের উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন ছাত্ররাজনীতি নেই। সেখানে শিক্ষার্থীরা নিজের মতো করে পড়াশোনা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে মূল প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে এসব অন্যতম।
আমাদের ফুলপরী খাতুন অসম্ভব সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু এমন হাজারো ফুলপরীর সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে। তাঁরা হয়তো সাহস করে সামনে আসতে পারছেন না। শিক্ষার্থীরা জাতির ভবিষ্যৎ। তাই সরকারের উচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অপ-রাজনীতিকারীদের এবং তাদের প্রশ্রয়কারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। আড়ালে থাকা হাজারো ফুলপরীর ওপর যেন নির্যাতন না হয়, সে ব্যবস্থা করা।
*লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।