প্রযুক্তিগত অদক্ষতাই কি বেকারত্ব বাড়াচ্ছে

ফাইল ছবি

পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে। সেই সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে সভ্যতাও। কিন্তু বাংলাদেশের মতো সম্ভাবনাময় দেশে প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রতি শিক্ষার্থী, চাকরিপ্রার্থীসহ সবার অনীহা এখন একটা সংস্কৃতির কাতারে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে সরকারি চাকরির প্রতি অত্যধিক টান বেকারত্ব আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠছে না।

তাহলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে কীভাবে? আমাদের শুরুতেই গলদ। অপরিণত বয়সে বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানোর প্রতিযোগিতায় আমরা মেতে উঠি, কিন্তু পরিণত বয়সে সন্তানকে দক্ষ হতে সাহায্য করি না। আমরা ভোগ–বিলাসে ব্যস্ত, আমাদের শিক্ষার্থীরা শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যেই নিয়োজিত। বহুমাত্রিক জ্ঞানের অধিকারী খুব কম শিক্ষার্থী। বিশেষ করে প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রতি অনীহা বাংলাদেশকে দিন দিন পিছিয়ে দিচ্ছে।

সরকার স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ বিষয় বাধ্যতামূলক করেছে। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার্থীরা কি আইসিটি শিক্ষায় নিজেকে দক্ষ করতে পারছে? বেশির ভাগ স্কুল–কলেজেই ল্যাব নেই, চর্চার সুযোগ নেই। তাহলে বই মুখস্থ করে যদি হাতেকলমে শিক্ষালাভ না করতে পারে, গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত না হয়, তাহলে এই শিক্ষার মূল্য কিসে? এ ছাড়া লক্ষ করা যায় আইসিটির ওপর পারদর্শী নন, এমন শিক্ষককে দিয়ে আইসিটি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, যা নামমাত্র আইসিটি শিক্ষা।

এ প্রভাব পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরিণত বয়সের। উন্নত বিশ্বে পড়াশোনার কাজে প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক বেড়েছে। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীরা এর ব্যবহারই বোঝে না। মূলত অলসতা, স্বেচ্ছায় আগ্রহ প্রকাশ না করাই মূল কারণ।

সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছে, কিন্তু আমরা সেটা আমলে নিই না। তবে এটাও সত্য, বিভিন্ন অর্থবছরে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বাজেট থাকে, তার কত অংশইবা শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বিকাশের পেছনে ব্যয় হয়? প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রতি আগ্রহ প্রাকৃতিকভাবে না এলে কাউকেই জোর করে শেখানো যাবে না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী একটা প্রেজেন্টেশন স্লাইড তৈরি করতে পারে না, অ্যাসাইনমেন্টের কাভারপেজ, টাইপিং করতেও দোকানে যেতে হয়। অথচ বাড়িতে ল্যাপটপ, ফোন—সবকিছু ব্যবহৃত হচ্ছে ফেসবুকের পাতা ঘাঁটতে, গেম খেলতে, মুভি দেখতে, ইউটিউব ঘাঁটতে।

সেই শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে ‘বিসিএস’ শব্দটা শোনা যায়। সবাই একদিকে ছুটেছে বলেই প্রতিযোগিতা বেশি। সৃষ্টিশীল কাজের প্রতি চরম অবহেলা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দিন শেষে অদক্ষতা নিয়ে এ শিক্ষার্থীরাই বাংলাবাজার, নীলক্ষেতের সব বইয়ের পৃষ্ঠা মুখস্থ করে চাকরির বাজারে লড়াই করে চলেছে। অথচ অসীম প্রতিযোগিতার বাইরে যারা নিজেকে প্রযুক্তিগত দিকে দক্ষ গড়ে তুলেছে, ইতিমধ্যে তারা আজ সাফল্যের বড় চেয়ারে বসে আছে, তাদের আর পেছনে তাকানোর সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিংয়ে অষ্টম শীর্ষ দেশ। বিশ্বের ৬৪ শতাংশ ‘টপ রেটেড’ ফ্রিল্যান্সার বাংলাদেশের। বছরে আয় হচ্ছে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার, টাকার অঙ্কে যা ১ হাজার কোটি। তারা কি শিক্ষিত নয়? বিদেশি গ্রাহকের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলছে তারা, সবাই কমবেশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করেছে। সবকিছুর মাঝেও কীভাবে তারা এত দূর এল? এর জন্য রয়েছে একান্তই সদিচ্ছা ও একাগ্রতা। এটাও ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালে আয় হবে ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৭ সালে ফ্রিল্যান্সিং হবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী আয়।

এখানে ফ্রিল্যান্সাররা আয় করতে পারলে কেন চাকরিপ্রার্থীদের সামান্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা থাকবে না?

এক সমীক্ষায় দেখা গেল, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কম্পিউটারে পারদর্শী—এমন চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগদান করছে। যারা যত দক্ষ, তাদের সরাসরি তত বড় পদে পদায়ন করা হচ্ছে। অধিকাংশ প্রার্থীই নিজেদের দক্ষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ, কারণ তার সক্ষমতা বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তর করার মধ্যেই। তারা বাজারের কম্পিউটার বই, নোট মুখস্থ করে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু হাতেকলমে দক্ষতা নেই। ব্যাপারটা ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে গাড়ি চালানো, প্লেন চালানোর মতোই। কেউ শেখার জন্য পড়ছে না। কোনোরকমে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই আর কে পায়।

যেসব শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থী বলে থাকে বেসরকারি চাকরির নিরাপত্তা নেই, কাজের চাপ বেশি, তারা নিজেদের ফাঁকিবাজ প্রমাণ করছে এবং অদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। তাদের কাছে সরকারি চাকরি নিয়ে দায় ও দায়িত্ব পালনে অবহেলাই মূল উপজীব্য হয়ে দাঁড়াবে। বলুন তো ব্যাংক, বিমা, অধিদপ্তর—কোথায় প্রযুক্তির ছোঁয়া নেই? কেন একজন অদক্ষ চাকরিপ্রার্থী প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেবে? বেকারত্ব কি অকারণে বাড়ছে? আমি এটা বিশ্বাস করি, যোগ্যতা থাকলে যেকোনো স্থানে সাফল্য লাভ করা যায়। এটা সত্য যে চাকরির খালি পদ কম, কিন্তু এখানে যারাই চাকরি লাভ করছে, তারা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এবং দক্ষতাসম্পন্ন। কাজেই চাকরিপ্রার্থী ও নবীন শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলব, একবিংশ শতাব্দীতে এগিয়ে যেতে হলে নিজেকে প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন করতে হবে। অন্তত টিকে থাকার মতো দক্ষতা নিশ্চিত করতেই হবে। শুধু বইয়ের পড়া দিয়ে এই শতাব্দীতে ভালো কিছু আশা করা নিতান্তই বোকামি ছাড়া আর কিছু হবে না।

*লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।