১০০ ফিট মাদানী অ্যাভিনিউর অসমাপ্ত উন্নয়ন, জনদুর্ভোগের অবসান কবে?
রাজধানীর গুলশান-বারিধারা-বসুন্ধরা হয়ে পূর্বাচলের সঙ্গে যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়ক ১০০ ফিট মাদানি অ্যাভিনিউয়ের উন্নয়নকাজ দীর্ঘদিন ধরে শেষ না হওয়ায় ধুলা, কাদা ও যানজটে ভোগান্তিতে পড়েছেন লাখো মানুষ। ওয়াসার পাইপ বসানো, রাজউকের রাস্তা প্রশস্তকরণ ও এমআরটি লাইন–৫–এর চলমান কাজে রাস্তায় যান চলাচলের লেন কমে গেছে। এতে অসুবিধায় পড়ছেন এলাকাবাসী, পথচারী, যাত্রী এবং রাস্তার দুই পাশের ব্যবসায়ীরা।
মাদানী অ্যাভিনিউয়ের উন্নয়ন যাত্রা
ঢাকার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কের ইতিহাস প্রায় সাত দশক পুরোনো। ১৯৫০–এর দশকে ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের (ডিআইটি) চেয়ারম্যান জি এ মাদানীর নামে সড়কটি করা হয়। গুলশান ও বারিধারার মতো নতুন আবাসিক এলাকার পরিকল্পনা শুরু হয় তখন। বহু বছর পর ২০১০ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) মাদানী অ্যাভিনিউকে ৭ কিলোমিটার প্রসারিত করে পূর্বাচলের সঙ্গে সংযুক্ত করার উদ্যোগ নেয় এবং ২০১৬ সালে এটিকে ৬ লেনবিশিষ্ট আধুনিক সড়ক হিসেবে উন্নীত করার প্রকল্প অনুমোদন করে। এরপর ২০২০ সালের দিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের (ওয়াসা) যৌথ প্রকল্প ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্টের আওয়ায় এই সড়কের নিচ দিয়ে বিশাল পানীয় জল সরবরাহ পাইপলাইন বসানোর কাজ শুরু হয়। এই প্রকল্পের কারণে ২০২৪ সালে শুরু হয় ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি, যা ট্রাফিক ও স্থানীয় জনজীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। তা ছাড়া বর্তমানে মেট্রোরেল সিস্টেমের অংশ হিসেবে এমআরটি লাইন–৫–এর আন্ডারগ্রাউন্ড ইউটিলিটি স্থানান্তরের কাজ চলছে।
জনদুর্ভোগের চিত্র
রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে নতুনবাজার, ভাটারা, বসুন্ধরা ও গুলশানগামী হাজারো মানুষ দীর্ঘ সময়ের যানজট, ধুলা, কাদা ও চলাচলের অসুবিধাসহ নানা ভোগান্তিতে পড়েছেন। বিশেষত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, হাসপাতালের চিকিৎসক, রোগী, দোকানদার, পরিবহন চালক ও অফিসগামী মানুষ প্রতিদিন এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
মাদানী অ্যাভিনিউয়ের ইউনাইটেড সিটিতে অবস্থিত ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী প্রতিদিন প্রত্যক্ষভাবে এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ আশপাশের অন্তত ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ সবাই প্রভাবিত হচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বারিধারা, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বসুন্ধরা, ছোলমাইদ উচ্চবিদ্যালয়, ভাটারা, লাইট ফেয়ার স্কুল, সাঈদনগর, কানাডিয়ান ম্যাপল আন্তর্জাতিক স্কুল, ইউনাইটেড সিটি, দারুল হিকমাহ ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও দারুস সালাম হুসেইনিয়া মাদ্রাসার ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা, যাঁরা প্রতিদিন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সামিহা জামান বলেন, ‘রাস্তার ধুলার কারণে হাঁচি, কাঁশি, এলার্জি লেগেই থাকে, এমনকি চোখের সংক্রমণও দেখা দিয়েছে। অপর দিকে একটু বৃষ্টি হলেই কাদা এবং পানি জমে যায়। ২০ টাকার রিকশাভাড়া এখন দিতে হয় ৪০ টাকা।’
আরেক শিক্ষার্থী অরুপ চন্দ্র বলেন, ‘সাঈদনগর মোড়ের চারদিকেই রাস্তা কেটে রাখা হয়েছে। ফলে একই লেনে গাড়ি চলাচল করে একাধিক দিক থেকে। দুর্ঘটনাও ঘটে প্রচুর। রিকশা উল্টে যাওয়া, চাকা বেঁকে যাওয়া এই নিয়ে ভীষণ ভয়ে ভয়ে যাতায়াত করতে হয়।’
সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী মেহেজাবিন বলেন, ‘নতুনবাজারে আমার বাসা থেকে স্কুলে যেতে সাধারণত ১০ মিনিট সময় লাগলেও এখন রাস্তা খুঁড়ে রাখায় যানজটের কারণে প্রায় আধা ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় লাগে। রিকশাভাড়াও আগের চেয়ে বেশি।’
হাসপাতালগুলোর ক্ষেত্রেও ভোগান্তি চরমে। ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতাল, ফরাজি হাসপাতাল ও মাদানী হাসপাতালসহ আশপাশের সব হাসপাতালের চিকিৎসক, রোগী ও স্বজনদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এমনকি অ্যাম্বুলেন্সে রোগী সরবরাহের ক্ষেত্রেও বিপাকে পড়তে হয় বলে জানান অ্যাম্বুলেন্সচালকেরা। অনেক ক্ষেত্রে যানজটের কারণে জরুরি সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। ফরাজি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা এক গর্ভবতী নারী বলেন, ‘এই রাস্তায় রিকশা-গাড়িতে চলা খুব কঠিন হয়ে গেছে, শরীরের উপর ভীষণ চাপ পড়ে। ডাক্তার দেখাতে আসব সে ক্ষেত্রেও রাস্তার কারণে কষ্ট হয়।’
বাণিজ্যিক ও বাজার এলাকা যেমন নতুনবাজারের সিদ্দিক সুপারমার্কেট, আলাউদ্দীন মার্কেট, হাজী মোমেন উদ্দীন খন্দকার সুপারমার্কেট, স্বপ্ন সুপার শপ, ফ্যামিলি বাজার, আরএফএল বেস্ট বাই–এর মতো মার্কেটের ব্যাবসায়ীরাও জানান দুর্ভোগের কথা। দোকানিরা জানান, দোকানের সব মালামালে ধুলা জমে যায়। বর্ষায় কাদা আর শুকনা মৌসুমে ধুলার কারণে ক্রেতারা রাস্তার ধারের দোকানগুলোতে আসতে চান না। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন ধুলা-কাদার কারণে ক্রেতা কমে যাওয়ায় অনেকগুলো দোকান প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। একই সঙ্গে বিপরীত চিত্রও ফুটে উঠেছে, রাস্তায় যান চলাচল ধীরগতির হওয়ায় ফুটপাতে ও রাস্তার অর্ধেকজুড়ে গড়ে উঠেছে প্রায় দেড় শতাধিক ভাসমান ভ্যান দোকান।
ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোও প্রভাবিত হচ্ছে মাদানী অ্যাভিনিউয়ের এই উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে। এতে রয়েছে বাইতুল মামুর জামে মসজিদ, ভাটারা সেন্ট্রাল জামে মসজিদ, ইউনাইটেড সিটির মসজিদ আর মুস্তাফা, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মসজিদসহ এলাকার আরও কয়েকটি মসজিদ ও মাদ্রাসা। নতুনবাজার মাদানী অ্যাভিনিউসংলগ্ন বাইতুল মামুর জামে মসজিদে সালাত আদায় করতে আসা এক মুসল্লি বলেন, প্রত্যেক দিন নামাজের সময় মসজিদের সামনে জ্যাম হয়। মসজিদের ভেতরে পর্যন্ত গাড়ির হর্ন আর ধুলাবালু ঢুকে যায়। এ ছাড়া সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় যেমন শ্রীশ্রী ভাটারা কালীমন্দির, শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দ মন্দির, সাইদনগর, খ্রিষ্টানদের উপাসনালয় ভাটারা চার্চ, নয়ানগর এজি চার্চ, বেলহেম ব্যাপ্টিস্ট চার্চসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোই প্রভাবিত হচ্ছে।
প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষ এই করিডরে যাতায়াত করতে গিয়ে বিপুল ভোগান্তির মুখোমুখি হচ্ছেন। শিক্ষার্থী থেকে ব্যবসায়ী, রোগী থেকে পথচারী—সবাই ধুলা, কাদা ও দীর্ঘ সময় ধরে যানজটের কারণে দৈনন্দিন চলাচলে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। জনসাধারণের মনে এখন প্রশ্ন, এই ভোগান্তির অবসান কবে?
লেখক: ফারহানা ফাইজা