জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সেকাল-একাল
জাতীয় সংসদ নির্বাচন মানে জাঁকজমক এক উৎসবমুখর পরিবেশ। গত নির্বাচনগুলোতে আমরা ভোটার না হলেও শৈশব থেকে এ নির্বাচনী আমেজ বেশ উপভোগ করেছি। নির্বাচন শব্দটির ধারণা আসে ক্লাস ক্যাপ্টেন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা শুনলে কেমন যেন বড়সড় ভাবনা বাসা বাঁধে মনে। আমরা অবশ্য শুরুতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন শব্দের সঙ্গে পরিচিত হইনি। সরকার নির্বাচন নামে প্রচলন ছিল আমাদের পারিপার্শ্বিকে। আমরা ভাবতাম সরকার কী। শুনলাম দেশ চালায়। দেশ কি গাড়ির মতো, চালায় কীভাবে? আচ্ছা, আমার বন্ধুর নামের শেষে তো সরকার, তারা সবাই কি তাহলে সরকার? তারা কি নির্বাচন করে সরকার হয়েছে?
আমরা যারা ২০০২ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে জন্মগ্রহণ করেছি। আমাদের জীবনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনই প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যেখানে আমরা ভোট দিতে পারব। আমাদের জন্মগ্রহণের পর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালে। তখন সবে আমরা স্কুলের দরজায় পা দিয়েছি। সেবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। তা নিয়ে তখন আমাদের মাথাব্যথা ছিল না। আমরা দল বেঁধে পোস্টার ও লিফলেট সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলাম। আমাদের মধ্যে তখন প্রতিযোগিতা ছিল কে কত বেশি পোস্টার ও লিফলেট সংগ্রহ করতে পারি তা নিয়ে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বৃহত্তর দলগুলোর স্লোগান আমাদেরও প্রভাবিত করেছিল আংশিকভাবে। আমরা স্কুলে এসব স্লোগান দিতাম আর শিক্ষকদের বকুনি খেতাম। এলাকাতে গালমন্দ শুনতে হতো স্লোগান মিশ্রণের ফলে। কোন দলের স্লোগান কোন দলে যে মেশাতাম, তা তখন বুঝতাম না। এরপর ২০১৪ সালে আসে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তখন রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে আমাদের মধ্যে জোরদার ধারণা হয়, যদিও তা প্রাথমিক পর্যায়ে। চারদিকে হরতাল, ভাঙচুর ও আগুন-সন্ত্রাসের ভিড়ে আমাদের কোমল মনে তখন নির্বাচন সম্পর্কে এ ধারণা জন্ম নিয়েছিল যে নির্বাচন, রাজনৈতিক দল বা রাজনীতি—এসব ভালো জিনিস নয়। এগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। আমরা যারা রাজনৈতিক পরিবারের বাইরে, তারা রাজনীতি নিয়ে বিরূপ ধারণা লালন করতে শুরু করলাম ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে। ওই বছর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, আমাদের বয়স তখন ১৮ ছুঁই ছুঁই, কারও কম কারও বেশি।
অল্পের জন্য প্রচলিত আইনে ভোটার হতে পারিনি। এবার অবশ্য আমাদের রাজনৈতিক ধারণাগুলোর পরিবর্তন হয়েছে। যতটুকু বুঝলাম, রাজনীতি রাষ্ট্রের নাগরিকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যবস্থা; যা দ্বারা রাষ্ট্র, নাগরিক ও তাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল। যেখানে রাষ্ট্র ও নাগরিক জড়িত, আমরা তো এর বাইরে নই। তাই আমাদের মনে প্রবল আকারে রাজনৈতিক জ্ঞানপিপাসা বাসা বাঁধতে থাকে। এ বয়সে এসে আমাদের বন্ধুমহলের যারা রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ লালন করত, তাদের অনেকে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনে নাম লেখায়। অন্যবারের মতো জাঁকজমক নির্বাচন না হলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের ক্ষমতা ধরে রাখে এবং টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে। সময় এখন ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তে। ইতিমধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। কয়েক দিন পেরোলে ২০২৪–এর ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
আমাদের বয়স এখন ১৮ থেকে ২২–এর মধ্যে। সংবিধান অনুসারে ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের প্রথম কোনো জাতীয় নির্বাচন, যেখানে আমরা ভোট দিতে চলেছি। প্রার্থী বাছাই, ক্ষমতার অতীত-বর্তমান, দেশের ভবিষ্যৎ সবকিছু এখন আমাদের ভাবনার বিষয়বস্তু।
আমাদের শৈশবের সেই লিফলেট ও পোস্টার জমানো বন্ধুমহলের অধিকাংশ আজ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে শুদ্ধ স্লোগান দিচ্ছে, নিরলসভাবে করে চলেছে নিজের সমর্থিত ব্যক্তির প্রচার। আর একাংশ প্রহর গুনছে জীবনের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটদানের আনন্দ উপভোগ করতে। দলমত–নির্বিশেষে আমাদের প্রত্যেকের স্বপ্ন শান্তিপূর্ণ, দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত বাংলাদেশের। সবার শুভচিন্তায় দ্বাদশের ক্ষমতায় যাঁরা আসবেন, তাঁদের কাছে আমাদের চাওয়া স্বপ্নগুলোর বাস্তবায়ন।
*লেখক: সুরঞ্জন মজুমদার, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়