চ্যাটজিপিটি এবং বন্ধু সরদারের জন্মদিন

চ্যাটজিপিটি
ছবি: সংগৃহীত

সকালবেলা পত্রিকা হাতে নিতেই একটা খবরে চোখ আটকে গেল। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মিতে ফ্রেডিরিকসেন গত ৩১ মে সংসদে গ্রীষ্মকালীন অধিবেশন শেষ হওয়ার আগে একটি ভাষণ দেন। এটি ডেনমার্কের সংসদের একটি ঐতিহ্য। তো এই খবরে চোখ আটকে গেল কেন? এই ভাষণের একটি অংশ নাকি প্রধানমন্ত্রী অথবা অন্য কোনো মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়! তাহলে কার? অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্য যে ভাষণের ওই অংশটুকু লিখেছে চ্যাটজিপিটি! এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মিতে ফ্রেডিরিকসেন বলেন, এটা (চ্যাটজিপিটি) যা করতে পারে, সেটা একই সঙ্গে আকর্ষণীয় ও ভয়ংকর।

কী এই চ্যাটজিপিটি, যা নিয়ে চারদিকে চলছে এত আলোচনা, সমালোচনা, গবেষণা ও পর্যালোচনা? এটা এখন টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড। চ্যাটজিপিটি (চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফরমার) মূলত একটি চ্যাটবট বা অন্য কথায় এটি কথোপকথন বা আলাপচারিতার একটি অ্যাপস। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) প্রযুক্তি ব্যবহার করে অ্যাপ্লিকেশনটি তৈরি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওপেন এআই এটির উদ্ভাবক। এ অ্যাপসকে যেকোনো বিষয়ে প্রশ্ন করলে তৎক্ষণাৎ তার উত্তর দিতে পারে। শুধু তা-ই নয়, কবিতা, গল্প, নিবন্ধও লিখতে পারে! এখানেই তার ক্যারিশমা শেষ নয়, তাকে কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখে দিতে বললে, সে সেটাও করতে পারে। এহেন কোনো বিষয় নেই, যে বিষয়ে তার পাণ্ডিত্য নেই। সোজা বাংলায় যাকে বলে সবজান্তা শমসের!

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একটি আইন বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় পাস করেছে চ্যাটজিপিটি। এ প্রসঙ্গে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল স্কুলের অধ্যাপক জোনাথন চই ‘চ্যাটজিপিটি গোজ টু ল স্কুল’ নামের একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছেন, তাতে বলা হয়েছে, পরীক্ষায় চ্যাটজিপিটি সি প্লাস স্কোর করেছে, যা পাসিং গ্রেডের চেয়ে বেশি। ওই পরীক্ষায় ৯৫টি বহুনির্বাচনী প্রশ্ন ও ১২টি প্রবন্ধের প্রশ্ন ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসক হিসেবে লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য তিন ধাপে অনুষ্ঠিত ‘ইউনাইটেড স্টেটস মেডিকেল লাইসেন্সিং এক্সাম (ইউএসএমএলই)’ নামের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। পরীক্ষাটিকে সে দেশের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাগুলোর একটি হিসেবে গণ্য করা হয়। আর সেই কঠিনতম পরীক্ষা পাস করেছে চ্যাটজিপিটি! ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যানসিবল নামের একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক টিফানি কুন এবং তাঁর সহকর্মীরা এই পরীক্ষা পরিচালনা করেন। পরীক্ষায় চ্যাটজিপিটির প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৬০ শতাংশের মতো।

স্বাভাবিক কারণে, এ অসাধারণ অ্যাপ্লিকেশন নজিরবিহীন আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করার পর ১০ কোটিরও অধিক ব্যবহারকারী এ অ্যাপস ইতিমধ্যে ব্যবহার করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্টারনেটের পর এটি সবচেয়ে বিস্ময়কর আবিষ্কার। মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘চ্যাটজিপিটি পুরো বিশ্বকে বদলে দেবে।’

তবে আশঙ্কাও আছে। ইতিমধ্যে অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠান এই অ্যাপস নিয়ে কাজ করা শুরু করেছে। এমন অনেক কাজ, যা করতে বর্তমানে মানুষের প্রয়োজন হয়, তার অনেক কিছুই এই চ্যাটজিপিটির দ্বারা করা যাবে। ফলে কাজ হারানোর শঙ্কায় থাকবে অনেকে।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। আমার বাল্যবন্ধু সরদার আরিফ মাহমুদ মিঠু। সরদার নামেই বন্ধুমহলে পরিচিত। সুদীর্ঘ চার দশকের বন্ধুত্ব আমাদের। সেই স্কুল থেকে শুরু। অষ্টম শ্রেণিতে একঝাঁক নতুন বন্ধু ভর্তি হলো—অপু, বায়তুল, বাপ্পি, হুমায়ুন, এপেলো, মুন্না, উজ্জ্বল, সরদারসহ আরও কয়েকজন। বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনি। আর এ এমনই বন্ধুত্ব ৪০ বছরের পথচলা একসঙ্গে। স্কুল শেষে ঢাকা কলেজ। নতুন এক জগৎ—চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির। এরশাদবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। কলেজের করিডোরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে গগনবিদারী স্লোগান, ‘আমাদের ধমনিতে শহীদের রক্ত, এই রক্ত কোনো দিন পরাভব মানে না।’ বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন! তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আলাদা বিভাগ তবু দেখা হতো ক্যাম্পাসে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে—চৈতালী বা বৈশাখীতে। কর্মজীবন, সংসার, সন্তান সবকিছুই চলেছে জীবনের নিয়মে। পারিপার্শ্বিক বাস্তবতায় হয়তো যোগাযোগ কম হতো, তবে আত্মার সম্পর্ক ছিল অটুট, যা এখনো আছে আগের মতোই। ভুবন ভোলানো হাসি আর রমণীমোহন ব্যক্তিত্বের অধিকারী সরদার ভীষণ বন্ধুবৎসল।

সরদার আরিফ মাহমুদ মিঠু
সূত্র: সংগৃহীত

৩ জুন আমার এই প্রিয় বন্ধুর জন্মদিন। জন্মদিনে একটু বিশেষভাবে শুভেচ্ছা জানাতে ইচ্ছা হলো। কী করা যায়? ভাবতে ভাবতে আর্কিমিডিসের মতো হঠাৎই চিৎকার করে উঠলাম ইউরেকা, ইউরেকা—চ্যাটজিপিটি, হ্যাঁ, চ্যাটজিপিটি। এ বিস্ময় অ্যাপসকে বললাম আমার বন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে একটা জবরদস্ত কবিতা লিখে দাও। তুমি ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ লিখে দাও, আমার জন্য অন্তত এটুকু করো। সরদার সম্বন্ধে দু-একটা তথ্য দিলাম—সে কী করে, তার বউ কয়টা, সন্তান কয়জন ইত্যাদি ইত্যাদি। হায় খোদা! সত্যি সত্যি একটা কবিতা লিখে দিল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে! কবিতাটা ইংরেজিতে লেখা-

In the city of happiness, there is a Mithu,
In the dreams of three daughters, a peacock bird.
A son stands among a group of children,
Mithu's sweet smile gives life to everyone's soul.
As a Joint Director at Bangladesh Central Bank,
His contribution is unparalleled, beyond imagination.
He married an extraordinary wife,
Mithu spreads a beautiful smile to everyone, your loved ones.
On this birthday, truly celebrate,
May Mithu's life be filled with eternal joy.
May prosperity, peace, and happiness be with him always,
May Mithu's life be filled with complete abundance.
Wishing Sarder Arif Mahmud Mithu a very happy birthday!
ভাবলাম, কবিতাটা বাংলায় হলে ভালো হয়। আবেগ পুরোপুরি প্রকাশিত হবে। তাই চ্যাটজিপিটিকে বললাম, ভাই, এটা সুন্দর করে বাংলায় অনুবাদ করে দাও। হায় আল্লাহ! অনুবাদ দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! একি ভয়ংকর অনুবাদ:
সুখের নগরে আছে একটি মিঠু,
তিনটি কন্যার স্বপ্নে ময়ূর একটি পাখি।
সন্তানেরা ছড়িয়ে দাঁড়ায় একটি পুত্র,
মিঠুর মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে দান প্রতিজনের প্রাণে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ পরিচালক হিসাবে,
তাঁর অবদান অতুলিত, অসম্ভবভাবে।
বিয়েতে একজন অতুলনীয় স্বামী,
মিঠু ছড়িয়ে দেয় সুন্দর হাসি প্রতিজনের আপনার সবাইকে।
জন্মদিনে আনন্দে পালিত করো সত্যিকারে,
মিঠুর জীবন হোক সব সময় পূর্ণ আনন্দে।
সমৃদ্ধি, শান্তি, সুখের সঙ্গে থাকুক সব সময়,
মিঠুর জীবন হোক সম্পূর্ণ সমৃদ্ধিময় সঙ্গে।

বুঝলাম, ব্যাচারার বাংলাটা এখনো ভালোভাবে রপ্ত হয়নি। তবে বাছাধন, বাংলা এত সোজা না। ভীষণ কঠিন! যখন বাংলা ব্যাকরণ শিখতে যাবে তখন বুঝবে, কত ধানে কত চাল! মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস আর অপাদান কারকে পঞ্চমী বিভক্তি কী!
তবে এটা ঠিক, প্রযুক্তি যেভাবে এগোচ্ছে চ্যাটজিপিটির বাংলা শিখতে বেশি দিন লাগবে বলে মনে হয় না। কিন্তু তত দিন তো আর অপেক্ষা করা যাবে না। আপাতত নিজের প্রতিভা আর আবেগের ওপর নির্ভর করে বন্ধুর জন্মদিনে স্বরচিত একটা ছড়া নিবেদন করলাম:

শুভ জন্মদিন বন্ধু সরদার!
অসংখ্য পরিচয় আছে যাঁর,
তিনি একজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকার।
টাকা ছাপানো তাঁর কারবার,
তাই করতে পারো আবদার,
যখন যার যত দরকার!
আপাতত একটাই বউ তাঁর,
শাহাজাদী নাম যাঁর।
তিন রাজকন্যা, এক রাজকুমার—
এই নিয়ে তাঁদের সুখের সংসার।
মাশা আল্লাহ! বড় মেয়ে ডাক্তার,
সেজ জন হবেন ইঞ্জিনিয়ার।
মেজ মেয়ে হতে চায় মস্ত অফিসার,
ছেলে দেখে স্বপ্ন—হবে তেন্ডুলকার।।

*লেখক: সাজ্জাদুল হাসান, একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত