মুঠোফোনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এবং আমাদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন
তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে মানবজাতি প্রতিনিয়ত নিজেদের সমৃদ্ধ করছে। এ তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ক্রমবিকাশে মানুষের জীবনযাপন অনেক সহজ এবং আরামদায়ক হয়েছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পৃথিবীটা চলে এসেছে মানুষের হাতের মুঠোয়। এই যে ধরুন আপনার হাতের যে মুঠোফোন, সেটা বলতে গেলে পৃথিবীর চেয়েও বড় ও বিস্তৃত। এ ফোনকে একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা আবিষ্কারগুলোর একটা ধরা হয়। যেকোনো সময় যেকোনো বিষয়ে চাইলে পুরো পৃথিবী ভ্রমণ করতে পারেন আপনার হাতের এই ছোট্ট মুঠোফোন দিয়েই। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, উন্নয়নের স্বর্ণশিখরেই আমরা অবস্থান করছি এখন। তবে আমাদের এটাও মানতে হবে যে মুদ্রার উল্টো পিঠও রয়েছে। বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়ে জীবনযাত্রাকে সহজ করেছে যে মুঠোফোন, তারও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের অনেক ক্ষতিকর দিক রয়েছে।
চারপাশে মানুষের মুঠোফোনের ব্যবহারের দিকটি খেয়াল করলে বোঝা যায়, আমরা কেউই এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন নই। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মুঠোফোন চাপাচাপির এ যেন এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে চারদিকে। চলতে-ফিরতে, উঠতে-বসতে, ঘরে-বাইরে—যেখানেই চোখ পড়ে, সবাই যেন এই মুঠোফোন নিয়ে এক মহা ব্যস্ততায় মেতে রয়েছে। হয়তো কেউ কেউ প্রয়োজনেই এটি চালাচ্ছে। তবে অধিকাংশ মানুষই অপ্রয়োজনেই সারাক্ষণ মুঠোফোন চাপাচাপি করছে। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, টুইটার—আরও কত সব মোবাইল অ্যাপ। এই যে মানুষ তাদের মূল্যবান সময় অপচয় করছে এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে, সে বিষয়ে তার কোনো খেয়ালই নেই।
অতিরিক্ত মুঠোফোন ব্যবহারে শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষতিই হয়ে থাকে। সাধারণত দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে মুঠোফোনসহ যেকোনো ইলেকট্রনিকস ডিভাইসের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ জ্বালা করা শুরু করে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা মনে হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে চোখ খোলা রাখতেও ক্লান্তিবোধ হয়। তা ছাড়া চালানোর সময় ঘাড় বাঁকা করে মুঠোফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। এর ফলে ঘাড় ব্যথার সমস্যা হতে পারে। যাকে টেক্সট নেকও বলা হয়। অনেক সময় হেডফোন লাগিয়ে উচ্চ শব্দে গান শোনা হয়। এতে করে কানের সমস্যা হতে পারে।
এ ছাড়া অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের কারণে একজন মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত, দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা থেকে শুরু করে আরও অসংখ্য নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন হতে পারে। যেমন নমোফোবিয়া নামের একধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে তার মধ্যে। এটি এ রকম ফোবিয়া বা ভয়, যা মুঠোফোনের কারণে সৃষ্ট। মুঠোফোন বেশ দামি এবং সার্বক্ষণিক সঙ্গী হওয়ায় ব্যবহারকারীরা তা নিয়ে সর্বদা বেশ সতর্ক থাকেন।
তা সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে রূপ নেয় ফোবিয়াতে। তাদের মধ্যে মুঠোফোন হারিয়ে ফেলার কিংবা ঠিক জায়গায় আছে কি না, সব সময় তটস্থ থাকার এই ফোবিয়া বা ভয়ের রোগকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় নমোফোবিয়া বলা হয়। মাত্রাতিরিক্ত মুঠোফোন ব্যবহারের কারণে এ রকম আরও অসংখ্য মানসিক সমস্যায় ভুগতে হয় এর ব্যবহারকারীকে।
আরেকটি ভাবনার বিষয় হলো আমাদের কিশোর ও তরুণ সমাজকে নিয়ে। তারা যে হারে মুঠোফোন চালায়, সেটা সত্যিই ঝুঁকিপূর্ণ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মুঠোফোন আমাদের ব্রেনওয়েভে পরিবর্তন আনতে পারে। তরুণ প্রজন্মের স্মৃতিশক্তির ওপর এর বিরূপ প্রভাব রয়েছে। সুইস গবেষকেরা ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৭০০ কিশোর ও তরুণের ওপর বছরখানেক একটা গবেষণা করেছেন। এতে দেখা গেছে, মুঠোফোনের রেডিয়েশন তাদের মস্তিষ্কের বিকাশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। একটা দেশের কিংবা জাতির সম্পদই হলো তরুণ সমাজ। আর তারাই যদি এ রকম একটা ইলেকট্রনিকস ডিভাইসে আসক্ত হয়ে নিজেদের এবং দেশ ও জাতির সুন্দর একটি ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে দেয়, তাহলে সে জাতির আর ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি থাকে না।
এত সব নেতিবাচক আলোচনার পরও এটা অস্বীকার করা যায় না, মুঠোফোনের ভালো দিক নেই। অবশ্যই এর ইতিবাচক ব্যবহারের অনেক উপকারী দিক রয়েছে। আমাদের সব সময় এর পরিমিত ও প্রয়োজনীয় ব্যবহারের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, মুঠোফোন যেন আমাদের নয়, আমরাই যেন আমাদের কল্যাণে একে ব্যবহার করতে পারি। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হবে আমার নিজের কল্যাণে, জাতির কল্যাণে, সর্বোপরি পৃথিবীর কল্যাণে।
*লেখক: রিপন আল মামুন, শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।