স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী: পেছন তাকানোর সময় এসে গেছে

পেছন ফিরে তাকিয়ে নাকি সামনে চলতে নেই, এতে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু একটা দীর্ঘ গন্তব্যে যখন সেই পথ চলা, তখন গন্তব্যে পৌঁছানোর একপর্যায়ে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকানোও জরুরি, অন্তত গন্তব্যে পৌঁছানোর পথটা ঠিক আছে কি না, তা পরখ করার জন্য।

বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি আজ ছোট ছোট কদমে ৫০ বছরের এই অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ একটি অবস্থানে পৌঁছে গেছে। ইতিহাসের সময় পঞ্জিকায় ৫০ বছর খুব বেশি সময় নয়, কিন্তু মানুষের আয়ুষ্কাল বিবেচনায় এই ৫০ বছর একটি দীর্ঘ সময়। স্বাধীন বাংলাদেশের সম্মুখ পথে চলার পথের বেশির ভাগটাই এখনো বাকি। তাই এখন সময় এসেছে আত্মসমালোচনার। ৫০ বছরের এই যাত্রাকে সাফল্য-ব্যর্থতার দাঁড়িপাল্লায় দাঁড় করিয়ে একটি লক্ষ্য স্থির করার।

আত্মসমালোচনা অত্যন্ত কঠিন একটি বিষয়। কিন্তু জাতির সমৃদ্ধি অর্জনে আত্মসমালোচনার বিকল্প কিছু নেই। ইতিহাসের আয়নায় নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখে সামনে এগিয়ে চলার দুঃসাহস বেশির ভাগ জাতিই করতে পারে না বিধায় পৃথিবীতে এত নৈরাজ্য এবং সন্ত্রাসবাদ গেড়ে বসেছে। বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের রয়েছে সংগ্রামের ইতিহাস। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাঙালি ছিল সংগ্রামী এবং সাহসী জাতি। কিন্তু হাজার বছর তাদের প্রত্যাশার চাদরে বন্দী রেখে বিজেতা শাসকেরা কেবল শাসন আর শোষণ করে গেছে। ধনসম্পদে সমৃদ্ধ বাংলাকে লুটপাট করে বাঙালিকে রেখেছে কাঙাল করে। বাঙালির সবই ছিল কিন্তু ছিল না কেবল স্বাধীনতা।

১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেয়। অথচ তৎকালীন বাঙালি বুদ্ধিদীপ্ত এবং তুখোড় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের অদূরদর্শিতার খেসারত ২৪ বছর দিতে হয় পূর্ব বাংলার মানুষদের। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের নামে বাংলাকে বিভক্ত করে দেওয়া ছিল ইতিহাসে বাঙালির অস্তিত্বের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত। ধর্মীয় আলোকে বিভক্ত পাকিস্তানের এই অংশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) মানুষ স্বাধীনতা বদলে উল্টো শোষিত হতে থাকে। বাঙালি হয়ে যায় স্বাধীন দেশের পরাধীন জাতি। ধীরে ধীরে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে স্বাধীনতার জন্য শেষ পর্যন্ত অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হয় পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) মানুষদের। ভারত-পাকিস্তান ভাগের পরের ২৪ বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামে বাঙালির মূল দাবি হয়ে উঠেছিল অর্থনৈতিক মুক্তি, উন্নয়ন-বৈষম্য দূরীকরণ এবং গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে উভয় অংশের সম-অধিকার নিশ্চিতকরণ।

স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর বাঙালিকে পথ দেখাতে ভুল করেননি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েই, বাঙালি তার অবর্ণনীয় ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনে। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ তাই এক সুতোর গাঁথুনিতে একই বন্ধনে আবদ্ধ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মাধ্যমে দেশকে নেতৃত্ব শূন্য করার পাঁয়তারা করে ক্ষমতালোভী একটি কুচক্রী মহল। দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মসনদে অন্যায়ভাবে আরোহণ করে ঘাতক মোশতাক আহমেদ। নিমেষেই স্বাধীন দেশের আলোকিত জয়যাত্রাকে থমকে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে অবরুদ্ধ করে, পূর্ববর্তী পাকিস্তানি কায়দায় দেশ পরিচালনা করতে শুরু করে সামরিক শাসকেরা। বাংলাদেশের সংগ্রামী ইতিহাসের মূলভিত্তি ৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতাযুদ্ধকেও তারা যথারীতি অস্বীকার করতে থাকে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃত করতে উঠেপড়ে লাগে।

শুধু তা-ই নয়, জাতির পিতার খুনিদের ক্ষমা করে দিয়ে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করতে থাকে মোশতাক থেকে পরবর্তী সামরিক শাসকেরা। ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার উদিত রক্তিম সূর্য অস্ত যেতে থাকে সম্ভাবনাময় একটি দেশের মাথার ওপর থেকে। কিন্তু বাঙালিরা এবারও দমে যায়নি, ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়।

ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ, ৭ মার্চ ১৯৭১
ছবি: সংগৃহীত

বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন একটি শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে, পক্ষান্তরে সামরিক শাসকেরা ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে গিয়ে চালু করেছিলেন কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা।

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতি মন্থর গতিতেই এগোচ্ছিল। কিন্তু গত এক দশকে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে একধরনের বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি এবং নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন আমদের আত্মগৌরবের সূচনা করেছে। আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশে অগ্রগতি আজ ঈর্ষণীয়। অর্থনীতিতে পূর্বসূরি পাকিস্তানকে ছেড়ে গিয়েছে সেই কবেই। শুধু তা-ই নয়, ভারতের মাথাপিছু আয়কেও ছাড়িয়ে যাওয়া বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। সরকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ২০৪১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত করার। বিশ্ব বাংলাদেশের এই উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করছে। একসময়ের তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলে আখ্যায়িত করা বাংলাদেশকেই আজ তারা উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে।

এই উন্নয়ন আর অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বেশ কিছু মৌলিক সমস্যা। অঙ্কুরিত গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটাতে ১৯৯০-এর স্বৈরাচার এরশাদের ক্ষমতা হস্তান্তরের পর থেকেই আমাদের প্রচেষ্টা সত্যিই হতাশাজনক। এরশাদ পরবর্তী সময়ে যেখানে গণতান্ত্রিক একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি হওয়ার কথা ছিল, সেখানে আজ গণতন্ত্রকেই যেন আমরা গলাধঃকরণ করে ফেলছি। বাংলাদেশকে একসময় বিশ্বের প্রধান দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের দুর্নাম বেয়ে চলতে হয়েছে। এখনো দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ‘টি আই’ (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল)-এর ২০১৯ সালের তথ্যমতে বিশ্বে ১২তম।

অর্থ পাচারের মাধ্যমে দেশের সম্পদ ডাকাতি করে হাতিয়ে নেওয়া লোকের পরিমাণও দেশে কম নয়। ধনী-গরিব বৈষম্য তীব্রভাবে বেড়ে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্সের তথ্যমতে, বিগত এক দশকের অতিধনী বৃদ্ধির তালিকায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। এ ছাড়াও ধর্ষণ, গুম-খুন, নারী নির্যাতন, শিশুশ্রম, শিশু নির্যাতন, মাদক চোরাকারবারিসহ বিভিন্ন অপরাধ সমাজে বিস্তৃতি লাভ করছে।

আন্তর্জাতিক মহলে অভিযোগ উঠছে মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার হনন করা নিয়ে। পাশাপাশি মানব উন্নয়ন সূচকে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আশানুরূপ ফলাফল অর্জিত হয়নি।

বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

এসব ব্যর্থতার দায় স্বাধীনতা-পরবর্তী সব সরকারকেই নিতে হবে। দেশের প্রত্যাশিত উন্নয়নের এই ধীরগতি সংগ্রামী জাতি হিসেবে আমাদের জন্য সত্যিই পীড়াদায়ক। বিগত এক দশক বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য। সিইবিআর বলছে, ২০২০ থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির সূচকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে। এবং ২০৩৫ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। এটি নিঃসন্দেহে দেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে তারই ধারাবাহিকতার একটি সম্ভাব্য ফল।

সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে দেশকে সব বাধা ডিঙিয়ে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে সুসংহত করতেই হবে। নিন্দুকের মুখে ছাই ছিটিয়ে দিয়ে আমাদের প্রমাণ করতে হবে আমাদের সক্ষমতাকে। মুক্ত স্বাধীন ধারায় অসহিংস রাজনৈতিক পরিবেশে ফিরে আসতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। জাতীয় ঐক্য গড়ার জন্য কাজ করে যেতে হবে সব রাজনৈতিক নেতাকে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে হবে সমাজের সব স্তরে।

দুর্নীতি, অর্থ পাচারকারীদের যথাযথ আইনের আওতায় আনতে হবে। সব নাগরিকদের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং শ্রম শোষণ থেকে শ্রমিকদের রক্ষা করতে হবে। কৃষক, পোশাককর্মী এবং প্রবাসীদের জন্য দেশে সম্মানজনক একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোকে প্রতিহত করে সব ধর্মের অনুসারীদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঠিক এবং সুষ্ঠু চর্চার পথকে অবমুক্ত করতে হবে। বেকারত্ব দূর করার মাধ্যমে তরুণদের মেধা কাজে লাগাতে হবে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন এনে বাস্তব এবং প্রয়োগমুখী শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে।

সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে হাজারো মানুষের ঢল।
ছবি: দীপু মালাকার

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশকে এখন আগের তুলনায় আরও সক্রিয় হতে হবে। বাংলাদেশের কূটনীতিক সক্ষমতা আগের চেয়ে আরও বাড়াতে হবে। ভারত কিংবা চীননির্ভরতা নয়, বরং বাংলাদেশকে হতে হবে আত্মনির্ভরশীল একটি দেশ। এ ক্ষেত্রে বাড়াতে পররাষ্ট্রনীতির সম্প্রসারণ, গড়ে তুলতে হবে শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত এবং কূটনীতিক সর্বোচ্চ পথ অবলম্বন করতে হবে। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রে নিজেদের দেশকে প্রাধান্য দিতে হবে। বৈশ্বিক শক্তিধর দেশগুলোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আর এসব কেবল সম্ভব আমাদের অভ্যন্তরীণ সব বিভেদ ভুলে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই।

যোগ্য নেতৃত্বে, দক্ষ হাতে দেশবাসীকে সোনার বাংলা বাস্তবায়নের পথ দেখাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ঘাতকের বুলেটে মুহূর্তেই সোনার বাংলার স্বপ্ন ভেঙে যেন তছনছ হয়ে যায়। আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বঙ্গবন্ধুর দলটাই রাষ্ট্রক্ষমতায়। সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নটাকে নতুন করে বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেওয়ার পবিত্র দায়িত্বটাও তাঁরই সুযোগ্য কন্যার হাতে। তাই দেশের প্রত্যাশা তার কাছেই বেশি। দেশের মানুষ বিশ্বাস করে শেখ হাসিনা তাঁর যোগ্য নেতৃত্বের গুণাবলির মাধ্যমেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন আরও অনেক দূর। আগামী প্রজন্মের জন্য বঙ্গবন্ধুর সব আশা তিনি নিজ হাতে সম্পাদনা করে যাবেন।


*আকিজ মাহমুদ, শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।