স্বপ্নের শহর অরোভিল
একজন মানুষ তার স্বপ্নে যে রকম শহর খুঁজে বেড়ায়, সে রকম শহর যদি বাস্তবে এসে হাতে ধরা দেয়, তাহলে কেমন হবে!
ভাবুন এমন একটি শহরের কথা, যেখানে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শ্রমিক, কর্মকর্তা—সবার বেতন সমান, মাত্র ১২ হাজার। এত কম বেতন হওয়ার পরও তাঁদের মধ্যে নেই কোনো রেষারেষি। যেখানে নেই রাজনীতি, নেই দারিদ্র্য, নেই অপরাধ, এমনকি নেই মুদ্রার নোটও। কী ভাবছেন? নিছক কল্পনা? কল্পনার রাজ্য মনে হলেও বাস্তবেই এমন এক শহর রয়েছে।
বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষ এই শহরে বাস করতে পারেন নির্দ্বিধায়। চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক যে শহরের সবার আয় সমান, সেটি সম্পর্কে।
শহরটির নাম অরোভিল। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের ভিলুপুরাম জেলায় শহর এটি। এর কিছু অংশ পাশের পদুচেরি রাজ্যে বিস্তৃত। ‘অরোভিল’ নামটির উৎপত্তি ফরাসি শব্দ ‘অরোর’ (Aurore) থেকে, যার অর্থ ‘ভোর’। তাই অরোভিল ‘ভোরের শহর’ নামেও পরিচিত। এ ছাড়া অনেকের মতে শহরটির নাম অরোভিল হয়েছে ভারতের বিশিষ্ট দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক গুরু যোগী শ্রী অরবিন্দের নামানুসারে। তিনিই ছিলেন এ শহরের স্বপ্নদ্রষ্টা। শ্রী অরবিন্দর ফরাসি বংশোদ্ভূত সহকারী মিরা আলফাসা প্রথম তাঁর গুরুর এ স্বপ্নকে একটি মূর্তরূপ দান করেন।
অরবিন্দ ছিলেন একাধারে ভারতের একজন প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা, সাধক ও দার্শনিক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনসহ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে তাঁর অবদান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলনকালে বিভিন্ন সময় জেলে বন্দী থেকেছেন। কারাগারে থাকাকালেই তিনি আধ্যাত্মিক চর্চা শুরু করেন। কারাগার থেকে মুক্তির পর পদুচেরিতে ১৯২৬ সালের ২৪ নভেম্বর অরবিন্দ আশ্রম গড়ে তোলেন। আশ্রম প্রতিষ্ঠায় তাঁর সহকারী হিসেবে ছিলেন মিরা আলফাসা। এরপর ১৯৬৪ সালে মিরা আলফাসা, তথা শ্রীমার সভাপতিত্বে পদুচেরিতে অরবিন্দর দর্শনের ওপর ভিত্তি করে একটি নগর প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এর কয়েক বছর পর ইউনেসকোর সহায়তায় অরোভিল শহর প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
অরোভিলে বর্তমানে ৪৯টি দেশের প্রায় ২ হাজার ৫০০ মানুষ বাস করেন। শহরের বেশির ভাগ নাগরিকই ভারতীয়। এ ছাড়া ফরাসি, জার্মানি, ইতালিয়ানসহ মোট ৫৪টি দেশের মানুষ বাস করেন শহরটিতে। এখানে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা আছে।
অরোভিল শহরের প্রধান আকর্ষণ মাতৃমন্দির। মূলত, সবাই এখানে ধ্যান করার জন্যই সমবেত হন। মাতৃমন্দিরটি ১ হাজার ৪০০ সোনার চাকতি দিয়ে মোড়ানো। দূর থেকে দেখতে যা খুবই আকর্ষণীয়। এ শহর খুবই পরিবেশবান্ধব।
সবুজ অরণ্যে ঘেরা এ শহর কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। এ শহরের শিল্প–সংস্কৃতি, আবাসস্থল, আন্তর্জাতিক প্যাভিলিয়ন এবং শিল্প–বাণিজ্যের এলাকা আলাদাভাবে বিভক্ত হওয়ায় সবার কাছে এটি আদর্শ নগরী হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছরই পর্যটকেরা ভিড় করেন এ শহরে।
অরোভিল একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শহর। এখানে রয়েছে ছোট ও মধ্যম মানের শিল্পকারখানা, প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও প্রশাসন। শহরের একদম কেন্দ্রে অবস্থিত ‘শান্তি এলাকা’। এ ছাড়া রয়েছে মাতৃমন্দির–সংলগ্ন সুদৃশ্য বাগান, অ্যাম্ফিথিয়েটার ও মানব–ঐক্যের নিদর্শন। এ ছাড়া শতাধিক দেশের মাটি দিয়ে ভরা একটি পাত্র এ এলাকায় সংরক্ষিত আছে। শহরের সামগ্রিক কাঠামো তৈরি করা হয়েছে সর্পিলাকারে।
অন্যান্য দেশ থেকে অরোভিলের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনেকটাই ভিন্ন। জেনে অবাক হবেন, এখানে টাকা বা ধাতব মুদ্রার প্রচলন নেই। এখানকার অধিবাসীদের একটি অস্থায়ী অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। ‘অরোকার্ড’ নামের একটি ডেবিট কার্ড থাকে সবার কাছে। এ কার্ডের মাধ্যমেই সব ধরনের লেনদেন সম্পন্ন করতে হয়।
অরোভিলের প্রশাসনিক কাঠামো তিন স্তরবিশিষ্ট। এখানে সরকারের হস্তক্ষেপ না থাকলেও ভারত সরকারের অনুমোদিত গভর্নিং বডি এর সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে। অগণিত সোলার প্যানেল দ্বারা এই শহরের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা হয়। অপরাধপ্রবণতা কমাতে ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে এ শহরে অ্যালকোহল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
*লেখক: রায়হান হোসেন, শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ