সব নারী হয়ে উঠুক একেকজন রোকেয়া

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

বিংশ শতাব্দীতে নারীকে ঘরকুনো বন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি বা নারী জাতি–সংশ্লিষ্ট যেকোনো ইতিবাচক বিষয়ে সময়ের সাহসী এক অগ্নিকন্যা ছিলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরে জন্মগ্রহণ করেন এই মহীয়সী নারী। জমিদার পরিবারের কন্যা বেগম রোকেয়া বড় ভাইয়ের সাহচর্যে এসে আলোকিত হন সুশিক্ষার আলোয়। অনুধাবন করতে সক্ষম হন, নারীদের বহির্জগতের বাস্তবতায় আরোহণ করানোর এখনই সময়। পরবর্তী সময়ে, খান বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে রোকেয়ার বিবাহ সম্পন্ন হয়।

শিক্ষিত ম্যাজিস্ট্রেট বাহাদুর সাহেব প্রথাগত চর্চার বাইরে আরোহণ করেন বেগম রোকেয়ার পড়াশোনার প্রতি অসীম আগ্রহের জন্য। বেগম রোকেয়ার স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের সাহচর্য মোড় ঘুরিয়ে দেয় রোকেয়ার জীবন তথা বাঙালি নারী সমাজের। চলমান প্রথা বা কুসংস্কারকে দূরে ঠেলে রোকেয়ার সুদূরপ্রসারী নেতৃত্বে বাঙালি নারী সমাজ এগিয়ে যায় বাস্তবমুখী শিক্ষার পথে। আজ আমরা নারী জাগরণের যে বাস্তবমুখী চিত্র লক্ষ করি, তার পথিকৃৎ নিঃসন্দেহে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। সেই পথপরিক্রমায় প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর দিনটি বেগম রোকেয়া দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

নামমাত্র নারী জাগরণ করে ক্ষান্ত হননি বেগম রোকেয়া। সৃষ্টি করেছেন নারী অধিকারের সপক্ষে অসংখ্য সাহিত্যকর্ম। ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামে একটি বাংলা গল্প লিখে সাহিত্যজগতে রোকেয়ার পথচলা শুরু। পরবর্তী সময়ে তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘মতিচুর’, ‘সুলতানার স্বপ্ন’, ‘অবরোধবাসিনী’ নামগুলো আজও বাঙালি নারী সমাজের কাছে ভালোবাসার এক আশ্রয়স্থল, এগিয়ে চলার প্রেরণা।

বেগম রোকেয়া সাংগঠনিক কাজকর্মে দেখিয়েছেন সুনিপুণ নেতৃত্বের ঝলক। ১৯০৯ সালে রোকেয়ার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন মৃত্যুবরণ করেন। এর পাঁচ বছর ভাগলপুরে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। সম্পত্তিসংক্রান্ত ঝামেলায় ১৯১০ সালে স্কুলটি কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। প্রাথমিক অবস্থায় স্কুলটি মাত্র আটজন ছাত্রী থাকলেও চার বছরের ব্যবধানে ছাত্রী সংখ্যা হয় ৮৪। ১৯৩০ সালের মধ্যে এটি হাইস্কুলে পরিণত হয়। স্কুল পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোকেয়া নিজেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখেন। ১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সভায় তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারীশিক্ষা–বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।

স্বীকৃতি

বাংলাদেশের সপ্তম বিভাগ হিসেবে রংপুর বিভাগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ ২০০৮ সালের ৮ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৯ সালে ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত’ হিসেবে তাঁর নামকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়টির বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করেন। উল্লেখ্য, নারীর নামে বাংলাদেশে প্রথম কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এটি।

এ ছাড়া, মহীয়সী বাঙালি নারী হিসেবে বেগম রোকেয়ার অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের আবাসনের জন্য ‘রোকেয়া হল’ নামকরণ করা হয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া পদক সম্মাননা দেয় সংগ্রামী নারীদের, যাঁরা গৃহ, কর্মে, সংগ্রামে বা অস্তিত্বে শত বাধা সত্ত্বেও এগিয়ে যান অবিরাম।

শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং উপমহাদেশের নারী জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে বেগম রোকেয়া থাকুক চির অম্লান—এটিই প্রত্যাশা আমাদের। আজকের নারীরা ভবিষ্যতে হয়ে উঠুক একেকজন রোকেয়া। বিনম্র হে মহীয়সী...

  • লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়