মায়ের ভাষা বাংলা চাই

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বায়ান্নর ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত পাঁচজন ভাষা শহীদের আবক্ষ ভাস্কর্য ‘মোদের গরব’ দেখছে দুই শিশু। তাদের হাতেও আঁকা রয়েছে একুশের আলপনাফাইল ছবি

বাঙালিদের জীবনে পথে পথে বাধা ছিল। আমাদের ভয়কে জয় করার জন্য শিহরণ জাগিয়ে তুলেছেন—কবির লেখা কবিতার লাইনগুলো যা—ভাষা আন্দোলনের পাখিদের (ছাত্রসমাজ) মুখেও একুশের মাতম উজ্জীবিত হতো কখনো গানে, ছন্দ ও সুরে; ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি/ ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি।’ তখন আমাদের অনেকেরই জন্ম হয়নি। বই পড়েই ভাষাশহীদদের জন্য চোখের জলও ঝিরঝির শব্দের মতো গড়িয়ে পড়েছিল। সেই সব শহীদের মর্মগাথা কথাগুলো বই থেকে, বই পড়েই লিখতে অনুপ্রাণিত হলাম।

একুশ মানে সাগরের কল্লোলতরঙ্গের মতো ছিল বাঙালির প্রাণ। ইতিহাসে বাঙালিদের চেতনার অদ্বিতীয় জয় জাগরণের ফসল হিসেবে মায়ের ভাষা বাংলার উন্মেষ ঘটে। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার গৌরব ও অধিকার অর্জনের দাবিতে মিছিলে–স্লোগানে মত্ত হয়েছিল শহর, বন্দর, গ্রামও। এতে রফিক, সফিউর, সালাম, বরকত, জব্বার তাজা রক্ত দিয়ে ইতিহাস রচনা করেছিলেন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, বাংলা ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮ সনে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত নিরীহ ছাত্রদের ওপর পুলিশের নির্মম গুলিবর্ষণে ওই তরুণেরা শহীদ হন। সে কথা ভোলার নয়। এই দিনটি জাতীয় শহীদ দিবস হিসেবে আমরা পালন করে থাকি।

একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় সর্বস্তরের মানুষ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ২১ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অধিকার সৃষ্টির প্রতিফলন পর্যালোচনা করার ফলে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলেও ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

১৯৬২ সালে আন্দোলন হয় শিক্ষা নিয়ে, ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ১১ দফার লড়াই, আগরতলা চক্রান্তের আন্দোলন, উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে সাধারণ জনগণের রায় ধাপে ধাপে বাঙালির স্বাধিকারের যুদ্ধে পরিণতি লাভ করে। এই দেশের উঠতি বয়সের দামাল ছেলেদের আত্মত্যাগের বিনিময়েও ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। সে কথাও ভোলার নয়...।

১৯৫২ সালের মাতৃভাষার আন্দোলনটি ছিল মর্যাদা রক্ষার পাশাপাশি চেতনায়ও দেশ রক্ষার গৌরব অর্জন। মাতৃভাষার সুরক্ষা, বিকাশ, অবাধ অনুশীলনের অধিকার ছাড়া কোনো জাতি প্রশংসিত হতে পারেনি।

সোনারগাঁয়ের সনমান্দী ইউনিয়নের দুজন ভাষাসৈনিকের নাম রেজাউল করিম ও মঞ্জুরুল হক সিকদার ’৫২–র একুশে ফেব্রুয়ারি রাজপথে যাঁরা নেমেছিলেন, তাঁরা এখনো বেঁচে আছেন। গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে আজও বাংলা ভাষার চর্চা আমরা পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারিনি। শৌচাগারকে টয়লেট, বাংলা কথার ফাঁকে ফাঁকে বাট, শিক্ষককে টিচার, শিক্ষার্থীদের স্টুন্টেডসহ আরও অজানা কথাগুলো যেখানে যখন যা বলা যায়, সেখানে মিশ্রণ নয়, যেকোনো একটি ভাষা বলা উত্তম। ভিনদেশি ভাষাও শিখতে সরকারিভাবে বাধা নেই, প্রয়োজন আছে। আজকের এই দিনে গভীর শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় অমর হয়ে থাকবেন ভাষাশহীদেরাও।

ফাইল ছবি

২০১০ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি পালন করা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালিদের কাছে ভাষা আন্দোলন বিশেষ দিন হিসেবে পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত ও গৌরবান্বিত।

*লেখক: মোহাম্মদ মহসীন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক