মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি
‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে। যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান জাতি গোত্র নাহি রবে’। কথাটা বলেছেন ফকির লালন শাহ। এমন সমাজ এখনো আছে। যেখানে জাতপাতের কোনো বালাই নেই, আছে কেবলই মানবিকতা। জানতে চান কী করে? বলছি শুনুন।
১২ এপ্রিল ২০২১ প্রথম আলোর ‘নাগরিক সংবাদ’–এ আমার লেখা একটা ফিচার ছাপা হয়। শিরোনাম ছিল ‘নুরু মিয়া- একজন টাকার পাহারাদার।’
নুরু মিয়ার আদি নিবাস ঢাকায়। পরিবারে আছে স্ত্রী, এক ছেলে, দুই মেয়ে। এক মেয়ে মারা গেছে। তাঁর ঘরে আছে এক নাতি। তার দেখাশোনা নুরু মিয়াকেই করতে হয়।
বয়স আর অভাবের ভারে নুরু মিয়া ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না। কাজ করেন রাজধানীর একটা বেসরকারি ব্যাংকের বুথে, দুবেলা শিফটিং ডিউটি। বেতন পান মাত্র আট হাজার টাকা। তা–ও মাঝেমধ্যে অনুপস্থিত থাকলে বেতন থেকে টাকা কাটা হয়। স্ত্রী অসুস্থ বলে ঠিকমতো রান্নাও করে দিতে পারেন না। তাই বুথে সামান্য কিছু খেয়েই পার করেন দিন। রোজ কামরাঙ্গীচর থেকে কাজে আসা–যাওয়া করেন হেঁটে। ছেলেমেয়েও ঠিকমতো দেখশোনা করে না।
আমার সেই লেখাটা চোখে পড়ে আমেরিকাপ্রবাসী সানি দত্তের। সানি দত্তকে আবেগতাড়িত করে নুরু মিয়ার জীবনের গল্প। তাই তিনি খুঁজে বের করেন লেখককে।
কথা হয় নুরু মিয়াকে নিয়ে। জাতিগোত্র ধর্ম–বর্ণ নয়, কেবল একজন মানুষ হয়ে আরেকজন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য উদ্গ্রীব হয়ে পড়েন সানি এবং সানিকে সব ধরনের সহযোগিতা করেন তাঁরই বন্ধুসম চাচাতো ভাই জুয়েল।
সানি নুরু মিয়ার সব খোঁজখবর নিয়ে চাচাতো ভাই জুয়েলার সহযোগিতায় সেই ব্যাংকের বুথের ব্যবস্থাপক সালাম সাহেবের মাধ্যমে নুরু মিয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা অনুদান পাঠান।
আনন্দে নুরু মিয়ার চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে। ধন্যবাদ জানান লেখককে আর সেই মহান হৃদয়ের মানুষকে, যিনি সুদূর আমেরিকা থেকে তাঁকে এতগুলো টাকা পাঠিয়েছেন। আর প্রথম আলোকে তো বটেই। প্রথম আলো আরও একটা গল্প লেখে নুরু মিয়াকে নিয়ে যার শিরোনাম ছিল, ‘১০ হাজার টাকা অনুদান পেলেন টাকার পাহারাদার সেই নুরু মিয়া’।
আমার এবং নুরু চাচার কাজের জায়গা একই পাড়ায় হওয়ায় প্রায়ই আমাদের দেখাসাক্ষাৎ হয়। খোঁজখবর নেই ওনার এবং ওনার স্ত্রীর। বেশ কিছুদিন ধরে ওনার স্ত্রী খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আমাদের দেশে অসহায় গরিব মানুষের জন্য সরকারি হাসপাতাল কতটা মানবিক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই চাচি কেমন আছে জিজ্ঞেস করলেই বলেন, ভালো না গো মা। কখন যে কী হয়ে যায় বলা মুশকিল । একটা দীর্ঘশবাস ফেলে চলে আসি।
মাঝেমধ্যেই আমেরিকা থেকে সানি জানতে চান আচ্ছা রাখী, নুরু মিয়া কেমন আছেন, ওনার স্ত্রীর অসুখ কি সারল? বলি—ভালো নেই ওনারা। একদিকে দেশে করোনার প্রভাব, তার ওপর ওনার স্ত্রী ভীষণ অসুস্থ। ঠিকমতো খাবারদাবার এমনকি চিকিৎসাও করাতে পারছেন না।
সানি আরও জানতে চান, নুরু মিয়ার সঙ্গে কথা বলার কোনো ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? বললাম, দেখুন ওনার তো কোনো ফোন নেই। আপনি চাইলে ডিউটি আওয়ারে ওনার ব্যবস্থাপক সালাম সাহেবের কাছে ফোন করে নুরু চাচার সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
তারপর অনেক দিন সানি এবং জুয়েলের কোনো খবর নেই। ভাবলাম কত মানুষের কত রকম খেয়ালখুশি, হয়তো ভুলেই গেছেন ওনারা নুরু চাচার কথা। তা ছাড়া বাংলাদেশে তো আর একজন নুরু মিয়া নেই, হাজারো নুরু মিয়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন দেশের আনাচে–কানাচে। কে কার খবর রাখে।
হঠাৎ সেদিন আবার সানি নক করলেন আমাকে। প্রথম আলোতে আমার লেখা একটা আর্টিকেল পাঠিয়ে বললেন, আপনার লেখাটা ঠিক বুঝতে পারিনি। বুঝিয়ে বলতেই জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা নুরু মিয়ার কী খবর? শুনেছিলাম ওনার স্ত্রী খুব অসুস্থ। নুরু মিয়ার কি এখনো কোনো ফোন নেই? বললাম, না ওনার ফোন নেই।
সানি: অহ। আমি দুইটা ফোন নুরু মিয়াকে কিনে দিতে চাই। আপনি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবেন?
কী করে?
ওনার কাছে পৌঁছে দেবেন এই আরকি।
দেখুন আপনি বরং ওনার ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলুন।
হ্যাঁ, সেটা জুয়েল বলবে কিন্তু আমি চাই আপনি আমাদের সঙ্গে থাকুন। তবে হ্যাঁ- রাখী এটা নিয়ে তো আবার কোনো গল্প লিখবেন না? আমি চাই না নিজিকে এভাবে জাহির করতে।
অবশ্যই লিখব। লোকে জানুক পৃথিবীতে এখনো ভালো মানুষ আছে। এখনো মানুষ মানুষকে ভজে। মানুষের কথা ভাবে।
ঠিক দুদিন পরে সানির চাচাতো ভাই জুয়েল আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে দুইটা ফোনের রিসিট পাঠালেন। আর বললেন, আগামীকাল সন্ধ্যায় সালাম সাহেবের কাছে ফোন দুইটা পৌঁছে যাবে। ম্যাম, আপনি একটু খোঁজ নেবেন। আসলে আমার কাজ লেখা। কে কাকে সাহায্য করবেন, এটা দেখার মতো সময় বা অবসর কোনোটাই সত্যিকার অর্থে আমার নেই। তবে ভালো লাগে নিজের লেখার জন্য যদি কোনো অসহায় মানুষের সামান্যতম উপকার হয় তাতে মন্দ কী!
তাই সেদিন সানিকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা আপনার কেন মনে হলো নুরু মিয়াকে ফোন কিনে দিতে হবে, তা–ও একটা নয়, দুইটা?
সানি অকপটে উত্তর দিলেন, দেখুন আমার মনে হলো নুরু মিয়ার ফোন নেই। উনি কাজে থাকা অবস্থায় তাঁর অসুস্থ স্ত্রীর খবর নিতে পারেন না, বিষয়টা খুব কষ্টের। তা ছাড়া একজন স্বামী হিসেবে অসুস্থ স্ত্রীর খোঁজ নেওয়া তার কর্তব্য। তাই দুইটা ফোন কিনে দিলাম। এর বেশি কিছু নয়। রাখী, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, এ ব্যাপারে আপনি আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। আশা করব ভবিষ্যতে আপনি এমন আরও অনেক নুরু মিয়াদের নিয়ে লিখবেন।
ফোন দুটো পাওয়ার পর নুরু চাচা আমাকে ফোন করেছিলেন। এত দোয়া আর ভালোবাসা অনেক দিন কারও কাছে পাইনি। যেন অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন বলে মনে হলো। কী মায়া, কী স্নেহ সেই জড়ানো ভাষায়, তা বর্ণনাতীত। ভালো থাক সব নুরু মিয়া।
সত্যি, এখনো মানুষ দাঁড়ায় মানুষের পাশে, এখনো মানুষ ভাবে মানুষকে নিয়ে। তাই তো সাধক লালন শাহ বলে গেছেন...।
‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
ও মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’
*লেখক: রোজিনা রাখী, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ