বিশ্ব ডিম দিবস: ডিম নিয়ে ভ্রান্ত ধারণার অবসান কবে

১৯৯৬ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় প্রথম ‘বিশ্ব ডিম দিবস’ পালন করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ডিমের গুরুত্ব এবং জনসাধারণের মধ্যে ডিম সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে ১৯৯৬ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় প্রথম ‘বিশ্ব ডিম দিবস’ পালন করা হয়। পরে প্রতিবছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার পালিত হয়ে আসছে এ দিবস। বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো ‘বিশ্ব ডিম দিবস’ পালন করা হয়। সেটি ছিল ১৮তম বিশ্ব ডিম দিবস। সেই থেকে প্রতিবছর সাধারণের মধ্যে ডিম সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডিম দিবস। পুরো বিশ্বেই দিনটি একসঙ্গে উদযাপিত হয়ে থাকে।

‘প্রতিদিন ডিম খাই, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াই’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এ বছর ২৫তম বিশ্ব ডিম দিবস পালিত হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি), পোলট্রি প্রফেশনাল’স বাংলাদেশ (পিবিবি), ওয়ার্ল্ডস পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ শাখাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবী সংগঠনের উদ্যোগে সম্মিলিতভাবে এদিন সারা দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজনের মধ্য দিয়ে ডিম দিবস পালন করে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যানুযায়ী, বছরে একজন মানুষের ন্যূনতম ১০৪টি ডিম খাওয়া উচিত। তবে আমাদের দেশের মানুষ বছরে ডিম খায় গড়ে মাত্র ৪৫-৫০টি। ডিমের নানাবিধ পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সবাই কমবেশি জানে। ডিম খাওয়া বাড়াতে বিশ্ব ডিম দিবস পালিত হওয়া ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার হিসেবে বিশ্বজুড়ে ডিমের ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও ডিম নিয়ে মানুষের মনে রয়ে গেছে অনেক ভ্রান্ত ধারণা, যা সম্পর্কে সচেতনতা জরুরি।

ডিম খাওয়া ভালো কী ভালো না, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক বহুদিনের। চীনে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের ওপর এক গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, প্রতিদিন একটি করে ডিম খেলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, ডিম থেকে শারীরিক উপকার পেতে হলে স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপন করতে হবে। তবে একসময় যে বলা হতো বেশি ডিম খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর, বিজ্ঞানীরা এখন সে মত পাল্টে ফেলেছেন। অনেকেই মনে করেন, দিনে একটির বেশি ডিম খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেন, দিনে তিনটি ডিম স্বাস্থ্যের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ। ডিম প্রোটিনের একটি আদর্শ উৎস। তাই প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য ডিমকে আবশ্যিক মনে করেন পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা।

ডিম শরীরে কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দেয়, ডিমের মধ্যে সালমোনেলা রয়েছে, তাই ডিম খাওয়া উচিত নয়—এমন খবর সংবাদমাধ্যমে প্রচার হয়েছে বহুদিন। অথচ ডিমকে ভালোভাবে রান্না করলে সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়ে যায়। সব ডিমে যে সালমোনেলা আছে, তা–ও কিন্তু নয়। ডিম পাড়ার পর ডিমটি নোংরা স্থানে পড়ে থাকলে কিংবা ডিমের গায়ে বিষ্ঠা লেগে থাকলে ডিমটি ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন স্থানে ডিম পাড়ার ব্যবস্থা করলে এবং ডিম ধুয়ে রাখলে ডিমে সালমোনেলা ঢোকার আশঙ্কা থাকে না।

অনেকে তর্ক করে থাকেন, লাল ডিম ও সাদা ডিমের পুষ্টিগুণ ভিন্ন। ডিম লাল হবে, নাকি সাদা, তা নির্ভর করে মুরগির পিগমেন্ট উৎপাদন ক্ষমতার ওপর। প্রকৃতপক্ষে সব রঙের ডিমের পুষ্টি উপাদান একই। তা ছাড়া অনেকেই আবার মনে করেন, ডিমের কুসুম যদি হলুদ হয়, তাহলে পুষ্টিমান বেশি। আর যদি কুসুমের রং হালকা হলুদ বা সাদাটে হয়, তাহলে তার পুষ্টিগুণ কম। এ ধারণাও একেবারেই ঠিক নয়। কারণ, ডিমের কুসুমের রং যা–ই হোক না কেন, এর সঙ্গে পুষ্টিগুণের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, ডিমের কুসুমের রং নির্ভর করে হাঁস-মুরগির খাদ্যের ভেতরে জ্যান্থোফিল নামে একধরনের পিগমেন্ট বা রঞ্জক পদার্থের উপস্থিতির ওপর।

বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো ‘বিশ্ব ডিম দিবস’ পালন করা হয়
ছবি: সংগৃহীত

অনেকে বলেন, ডিম মানুষের রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ উচ্চমাত্রায় বৃদ্ধি করে। পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে, সব ধরনের কোলেস্টেরল দেহের জন্য সমান ক্ষতিকর নয়। ‘স্যাচুরেটেড ফ্যাট’ নামে খারাপ কোলেস্টেরল দেহের রক্তচাপ বাড়ায় এবং হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করে। এমন ধারণা অনেকের মধ্যেই প্রচলিত থাকলেও সত্যটা হচ্ছে, ডিমে মাত্র ১.৬ গ্রাম স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ২০০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল রয়েছে, যা হৃদরোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী বলে মনে করা হলেও সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় এর ভিন্ন ফলও পাওয়া গেছে।

দেশি মুরগির ডিম ও ফার্মের মুরগির ডিমের মধ্যেও পুষ্টিমানের মৌলিক কোনো তফাত নেই। যে ডিমের আকার বা ওজন যত বড়, সে ডিমে প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, খনিজসহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদান তত পরিমাণ বিদ্যমান। তবে খাবারে বৈচিত্র্য থাকায় দেশি মুরগির ডিম স্বাদ ও গন্ধে অসাধারণ হয়। এ ছাড়া অনেকে ধারণা করেন, রান্না করা ডিমের তুলনায় কাঁচা ডিমে বেশি প্রোটিন থাকে। কিন্তু এর কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ নেই।

অনেকে মনে করেন, ডিম ও দুধ একসঙ্গে খাওয়া ঠিক নয়। ডিম ও দুধ—দুটিই প্রোটিনের আদর্শ উৎস। তবে ডিমের মধ্যে প্রোটিন ছাড়াও আছে অ্যামিনো অ্যাসিড, ভিটামিন ও আয়োডিন। অন্যদিকে দুধে রয়েছে ক্যালসিয়াম, যা দেহের বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। তাই সেদ্ধ ডিমের সঙ্গে এক গ্লাস দুধ প্রোটিনের পাশাপাশি অন্যান্য দরকারি পুষ্টি উপাদানগুলোর চমৎকার সামঞ্জস্য সৃষ্টি করে। ডিম ও দুধ একসঙ্গে খেতে কোনোই সমস্যা দেখেন না বিশেষজ্ঞরা।

আসল ডিম, না নকল ডিম, এটা নিয়েও ভোক্তাদের মধ্যে চরম ভ্রান্ত ধারণা লক্ষ করা যায়। নকল ডিম বলতে কৃত্রিমভাবে তৈরি প্লাস্টিকের ডিমকেই বোঝানো হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রায়ই নকল বা প্লাস্টিকের ডিমের বিষয়ে খবর আসে। দেশের বাজারে এই কৃত্রিম ডিমের অস্তিত্ব রয়েছে বলে অনেকে প্রচারও করে থাকেন। তবে সত্য এটিই, বাংলাদেশে কোনো নকল ডিমের অস্তিত্ব নেই।
*শিক্ষার্থী, প্রাণিসম্পদবিজ্ঞান ও ভেটেরিনারি মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি), গোপালগঞ্জ।

[email protected]