বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবদান

ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের অবদান অনন্য, তা আমরা প্রতিনিয়ত স্মরণ করছি। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেটিও সেমিনার–সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে প্রতিবছর উদ্‌যাপিত হয়। আর সেটা যথার্থ বটে। আরেকটি রাষ্ট্রের অবদানের গভীরতা অনেক। কিন্তু নাম যেন ভুলতে বসেছি। অবশ্য এর কারণও রয়েছে। রাষ্ট্রটি হলো তৎকালীন ইউএসএসআর, অর্থাৎ ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক, যা সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে পরিচিত। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন নামটি বিশ্ব তালিকা থেকে মুছে যায়। বিশ শতকের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন।

বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা গ্রেপ্তার করার পর বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান।

পাকিস্তান নয়টি মাস কী ধরনের অত্যাচার, জুলুম, অগ্নিসংযোগ, খুন ও ধর্ষণ চালিয়েছিল, তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। গোটা বিশ্বে এ নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সহানুভূতি পাওয়া গেছে। মার্কিন সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি ফ্রান্সের আর্দ্র মার্লো, আমেরিকা তথা বিশ্বখ্যাত গায়ক জর্জ হ্যারিসনসহ সবাইকে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। লক্ষ্য ছিল বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে আন্দোলন প্রচারের প্রাণকেন্দ্র, যার নেতৃত্বে ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।

ছবি : সংগৃহীত

১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডোনাল্ড ট্রামের উন্নত সংস্করণ রিচার্ড নিক্সন। জেনারেল ইয়াহিয়া তাঁর বন্ধু। তাই তিনি সব সময় ইয়াহিয়াকে সমর্থন দিয়ে এসেছেন। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বরে যখন পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সরাসরি যুদ্ধ বেধে গেল, তখন ভারত–বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী গঠন করা হলো। পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনা হলো। কিন্তু সেখান বাংলাদেশের নাম নেই। পক্ষ–বিপক্ষ হলো ভারত ও পাকিস্তান। অথচ সংঘর্ষের মূল ইস্যু ছিল বাংলাদেশ। ৭ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটি হলো। তাতে বস্তুত ভারত বিশ্ব কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হলো। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়ল ১০৪ এবং বিপক্ষে মাত্র ১১। কোনো মুসলিম রাষ্ট্র পক্ষে ভোট দেয়নি। পাকিস্তান-ভারত বৈরী সম্পর্কের কারণে মার্কিন কংগ্রেস উভয় দেশেই সব ধরনের সামরিক সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছিল। নিক্সন প্রশাসন দুটি মুসলিম রাষ্ট্র জর্ডান ও তুরস্কের মাধ্যমে যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছিল পাকিস্তানে। কর্মহীন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন গঠনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরুর অবদান ছিল। তাঁর কন্যা সেই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন গঠনের নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্রের নেতাদেরও সমর্থন পাননি। যুগোস্লাভিয়া, মিসর, ঘানা ও ইন্দোনেশিয়া প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। এ সময় জাতিসংঘে মার্কিন প্রতিনিধি ছিলেন সিনিয়র জর্জ বুশ (মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৮৯-৯৩)। মি. নিক্সন ও বুশের আনন্দ–উল্লাস দেখার মতো ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোতে এ প্রস্তাব ভেস্তে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নকে তিনবার ভোটো প্রয়োগ করতে হয়েছিল মার্কিন চক্রান্তকে ঠেকানোর জন্য।

ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় যুদ্ধবিরতি হলে পরিস্থিতিটা কী হতো। পাকিস্তানের হিংস্র জেনারেলরা কাদের বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিত, তা অনুমান করা লাগে না। সেই সঙ্গে থাকত আলবদর, আলশামসসহ জামায়াতে ইসলামী। আলবদর, আলশামসরা পতন অত্যাসন্ন জেনেও যে ভয়াবহ কাণ্ড করল, আর বিজয়ী হলে যে কত ভয়ংকর হতো, তা কল্পনাও করা যায় না। তাদের অন্যতম প্রধান কাজ হতো রোমান হরপে বাংলা ভাষা চালু করা। কেননা, ভাষা আন্দোলন যে স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ রোপণ করেছিল, এটা তারা ভালো করেই জানে। কোনো জাতি স্বাধীন হতে চাইলে তাকে একেবারে স্তব্ধ করা যায় না। বৈরী পরিবেশ বা সময়ের কারণে সময় লেগে যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চক্রান্ত সফল হলে আমাদের হয়তো আরও কয়েক যুগ লড়তে হতো।

এখানে আরও একটি বিষয়ে উল্লেখ করা প্রয়োজন। ১৯৬২ সালে চীনের সেনাবাহিনীর কাছি ভারতের সৈন্য ভীষণভাবে পর্যুদস্ত হয়। এর ফলে অনেকের বিশেষ করে মি. নিক্সনের ধারণা যে ভারতের চীন ফোবিয়া রয়েছে। ইতিমধ্যে ভারত–সোভিয়েত বন্ধুত্ব বেশ গভীর হয় এবং ১৯৭১ সালের আগস্টে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যে চীনকে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে ঢুকতে দেয়নি, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য অস্তির হয়ে গেল।

উল্লেখ্য, ডোনাল্ড ট্রাম্প যে শিষ্টাচার ভেঙে মার্কিন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে হাত মেলাননি, এটা নতুন নয়, মার্কিন ঐতিহ্যে রয়েছে। ১৯৫৪ সালে জেনেভায় ইন্দোচীন নিয়ে বৈঠক চলছিল, যেখানে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা, রাশিয়া, চীন সবাই যোগ দিয়েছে। সভাস্থলে করিডরে চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ইতিমধ্যে সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডালেস। চৌ এন লাই হাত মেলানোর জন্য তাঁর দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন। ডালেস সব শিষ্টাচার ভঙ্গ করে হাত না মিলিয়ে চলে গেলেন। সেই চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য অস্থির হলেন মি. নিক্সন। পাকিস্তানের মাধ্যমে হেনরি কিসিঞ্জার চীন–পাকিস্তান বন্ধুত্ব স্থাপন করলেন।

ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালের নভেম্বরে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি দল চীন গিয়েছিল চীনের কাছ থেকে কী ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যাবে, তা জানার জন্য। কেননা, চীন যদি ভারতের উত্তর সীমান্তে কিছুটা নড়াচড়া করে, তাহলে ভারত দুর্বল হয়ে পড়বে, এ ধারণা তাঁরা পোষণ করতেন। সেই টিমকে চীন অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছিল যে পাকিস্তান যেন পরিস্থিতিটা যুদ্ধ পর্যায়ে না নিয়ে যায়। যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের সঙ্গে রয়েছে, তাই চীন সেখানে নিজেকে জড়িয়ে ফেলবে না। কেননা, এর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চীন এক সংঘর্ষে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়েছিল। এ তথ্যের উল্লেখ রয়েছে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ আইনজীবী রফি রাজার লেখা বইয়ে। রফি রাজা ভুট্টোর ব্যক্তিগত বন্ধু এবং তার মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন।

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য স্বয়ং এবং মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন সদস্যকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু জাতিসংঘে ভোটাভুটিতে দেখা গেল যে সাধারণ পরিষদে ১০৪ ভোটের বিপরীতে ১১ ভোট এবং নিরাপত্তা পরিষদে ১১ ভোটের বিপরীতে ২ ভোট পেয়েছেন তিনি। প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে। সেখানে একটা শর্ত ছিল, একজন কোনো আগ্রাসনের শিকার হলে অপরজন তার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। যার ফলে সোভিয়েতের তিন ভেটো এবং চীনের পাকিস্তানের সদস্য এগিয়ে না আসায় ভারত–বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর দ্রুত সাফল্য অর্জন। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস থেকে, বিশ্ব তালিকা থেকে মুছে যাওয়া রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের নাম মুছে যাবে না, যেতে পারে না।

এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে বের হয়ে লন্ডনে যাওয়ার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিড তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখনো ইংল্যান্ড বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। তাই আমরা হিডের এই উদারতা খুব বাহবা দিই। কিন্তু এটুকু ভুলে যাই যে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করার পর বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিরা যে নির্যাতন চালায়, তা নিয়ে ব্রিটিশ সরকার তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। এমনকি বাংলাদেশের অনুকূলে জাতিসংঘের ভোটটিও দেয়নি।

  • লেখক: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা। souhardo 77 @gmail. com