প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের উচ্চতর গ্রেড ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দিন
সম্প্রতি প্রাথমিক প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দেওয়ার রায় হয়েছে হাইকোর্টের আপিল বিভাগে, যা খুবই ইতিবাচক এবং শিক্ষকসমাজের জন্য সুসংবাদই বটে। দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হলো প্রধান শিক্ষকদের।
অন্যদিকে, দেশে তিন লাখেরও বেশি প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক রয়েছেন, যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই স্নাতক-স্নাতকোত্তর শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন। কিন্তু তাঁদের দীর্ঘদিনের বেতনবৈষম্য রয়েই গেছে। ১৩তম গ্রেড প্রদানে সেই বৈষম্য নিরসন হয়নি। তাঁদের দাবি ছিল প্রধান শিক্ষকদের পরের স্কেলে বেতন পাওয়ার। অথচ সেটা হয়নি। করোনার আগে ঢাকায় শহীদ মিনারে মহাসমাবেশ করতে চাইলেও সেখানে তাঁদের ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। উল্টো বিক্ষোভ-প্রতিবাদে লাঠিপেটার শিকার হয়েছেন শিক্ষকেরা।
এর আগে ১১তম গ্রেডে বেতন স্কেল দেওয়ার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল সহকারী শিক্ষকদের! অথচ সেই আশ্বাস ছিল ফিকে। পাশাপাশি কিছু শিক্ষকনেতার লোভ-লালসাও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে! বেতনবৈষম্য নিরসনের পাশাপাশি শিক্ষক হিসেবেই তাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা পাওয়ার দাবি রাখেন। তা ছাড়া, মানুন কিংবা না মানুন, বিদ্যালয়ে ক্লাস ও অন্য কাজকর্মে সহকারী শিক্ষকেরাই অনেক বেশি শ্রম দিয়ে থাকেন। এমনিতে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রধান শিক্ষক পদে প্রমোশন হয় না অনেক সহকারী শিক্ষকের। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে অবসরে যান।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে এ দেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়। বাড়ানো হয় নানা সুযোগ-সুবিধা। ভিত্তি যেমন দুর্বল বা সুদৃঢ় না হলে দালানের কাঠামো নড়বড়ে হতে পারে, তেমনি জীবনের শুরুতেই প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন সঠিকভাবে না হলে পুরো শিক্ষাজীবনও সুদৃঢ় হবে না। এ জন্য প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক।
বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে সরকার। দেওয়া হচ্ছে পুরো সেট নতুন বই, উপবৃত্তি, মিড ডে মিল, নানা ধরনের শিক্ষাসামগ্রীসহ অনেক কিছু। পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষকদের নতুন ও আধুনিক প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হচ্ছে। দক্ষ ও চৌকস কর্মকর্তাও নিয়োগ পেয়েছেন, পাচ্ছেন প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে। এত কিছুর পরও প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য কোনোভাবেই দূর হচ্ছে না।
সব দেশেই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাকে শিক্ষার ভিত্তিমূল ধরা হয়, যা আমাদের দেশেও ব্যতিক্রম নয়। বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সরকারিকরণের কারণে সারা দেশের প্রায় সব প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শিক্ষকদের চাকরি সরকারি হয়েছে। তাতে রয়েছেন লাখ লাখ শিক্ষক। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো ঢালাওভাবে সরকারি করার সঙ্গে শিক্ষাবিদ, গবেষকসহ অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছেন।
প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেওয়ার রায় হলেও সহকারী শিক্ষকেরা থাকছেন তৃতীয়তেই। মূলত, নতুন বেতন স্কেলের মাধ্যমে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে শিক্ষকদের মধ্যে চরম বেতনবৈষম্যের সৃষ্টি করা হয়েছে বলে মনে করেন প্রাথমিক শিক্ষকেরা। প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে স্কেলের তফাত বিস্তর। বেতনবৈষম্য কমানোর জন্য নানা চেষ্টা-তদবির করেছে সহকারী শিক্ষক সংগঠনগুলো। কিন্তু ফলাফল আশানুরূপ নয়। স্কেলে বেতনবৈষম্য কোনোভাবেই যুক্তিসংগত হয়নি। যোগ্যতাভিত্তিক স্কেল প্রদান করা হলে এ ধরনের বৈষম্য থাকত না। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেতনবৈষম্য একটি বড় বিষয়।
শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য নিরসনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। উচ্চতর, তথা দশম বা এগারোতম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করার সহকারী শিক্ষকদের চাওয়া অবিলম্বে মেনে নিয়ে তা বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাই। আর কত উপযুক্ত সম্মানী থেকে শিক্ষকদের বঞ্চিত করা হবে?
এদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় ক্লাস রুটিন, বার্ষিক ছুটির তালিকাসহ (যেখানে জাতীয় দিবসগুলোও সংযুক্ত) নানা বিষয়ে অসামঞ্জস্য বিদ্যমান রয়ে গেছে। এসব সমস্যা নিরসনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্য ধরে রাখতে হলে বিজ্ঞানসম্মত ক্লাস রুটিন প্রণয়ন, শর্তহীন শতভাগ উপবৃত্তি প্রদানের পাশাপাশি শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য নিরসন করতে হবে। প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের উচ্চতর গ্রেডে বেতন স্কেল নির্ধারণ, দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদাসহ পদোন্নতি বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট