পুঁজিবাদের যৌবনে আমাদের অবস্থান
পুঁজিবাদের যৌবনে আমাদের অবস্থান। এখানে আমরা থেমে থাকলেও অনেকেই থেমে থাকবে না। এই পুঁজিবাদভিত্তিক সমাজে প্রতিযোগিতা আর প্রতিযোগিতা, কেউ যেন বসে থাকতে চায় না। প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের পাশাপাশি আমাদের সহযোগিতার মনোভাব বৃদ্ধি করতে হবে, যা আমাদের মধ্যে খুবই অপ্রতুল। পুঁজিবাদ আমাদের শিখিয়েছে, অন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেকে সামনে রাখতে পারলেই আমরা জয়ী। কিন্তু প্রকৃতিতে আমরা সে ব্যাপার লক্ষ করি না। প্রকৃতিতে মনোনিবেশ করে আমরা দেখতে পাই, যে কণাগুলো একে অপরকে যতটা জোরে ধরে রাখে, সেই ক্লাস্টার তত বেশি শক্ত এবং টেকসই। সুবোধ হিসেবে আমাদেরও ব্যাপারটা মাথায় রাখা দরকার।
‘সবার সঙ্গে সহযোগিতা শুধু নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা’। আজকের আমি থেকে কীভাবে আগামীকালের আমি আরও বেশি সুন্দর হবে, সেই চেষ্টায় সর্বদা রত থাকা দরকার। যোগ্যতা অর্জনের জন্য দরকার প্রতিযোগিতা, মানসিক তৃপ্তি লাভের জন্য দরকার সহযোগিতা। দুইটার কোনোটাকেই হেলাফেলা করে দেখার অবকাশ নেই। এ দুয়ের সমন্বয়ের পথে হেঁটে যেতে পারলেই পৃথিবীতে বর্তমান থেকে অনুভব করা যাবে স্বর্গীয় অনুভূতি। তবে এখন আমরা বিশ্বায়নের যুগে বসবাস করছি, এ ব্যাপারও মাথায় রাখা প্রয়োজন। সম্পূর্ণ বিশ্ব একটা গ্রামের ন্যায়। অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা, অভ্যন্তরীণ ব্যাপার—এ ধারণাগুলো সংকুচিত হচ্ছে দিনকে দিন। ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন আমরা নেটভিত্তিক সেসব সেবাই পাচ্ছি, যা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফিনল্যান্ড ইত্যাদি উন্নত রাষ্ট্রের নাগরিকেরা পেয়ে থাকেন। এখন আপনি–আমি ইচ্ছা করে সেই সেবা থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখে সময়ের দোষ দিতে পারব, কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে—সময় নয়, পিছিয়ে পড়ব আমরা নিজেরা। মহামারি করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার কারণে বিশ্বের একটা অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তাই বলে কি ঘড়ির কাঁটা বসে আছে? এটা একটা সর্বজনীন ব্যাপারে রূপ নিয়েছে। আপনার জন্য যা, অন্যের জন্যও তা।
আসলে এ অচল অবস্থার পেছনে আমাদের কারোরই হাত নেই, এটা আমাদের নিয়ন্ত্রণেও নয়। কিন্তু আমাদের কার্যকলাপ সম্পূর্ণটাই আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন।
দেখতে দেখতে অনেকটা সময় আমরা সাধারণ জীবনযাত্রা থেকে দূরে গিয়ে ভিন্নভাবে জীবন যাপন করছি। হয়তো সেই অঙ্কের সঙ্গে আরও কিছু অঙ্ক যোগ হতে পারে। যে সময়ে আমরা অপরিচিত অবস্থার অজুহাত দিয়ে নিজেকে অকারণে হতাশার সাগরে নিমজ্জিত করছি, ঠিক সেই সময় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবে ঘর হারানো পাখিরা পূর্বের তুলনায় শক্ত করে ঘর তৈরির দিকে মনোযোগ দিয়েছে। তারা কি স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিয়েছে? তাহলে আমরা সৃষ্টির সেরা হয়ে কেন হতাশা থেকে বের হয়ে জীবনীশক্তি সঞ্চয় করতে পারব না? তাই আমাদের জীবনের ব্যাপারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখাই শ্রেয়। আমরা সবাই একই ম্যারাথনের সহযাত্রী।
এখানে তারাই পুরস্কারপ্রাপ্ত হবে, যারা অন্যান্যভাবে তাদের ঘরবন্দী সময়টাকে হতাশার ঘোর থেকে বাইরে নিয়ে যেতে পারবে। পুরস্কার হতে পারে বস্তুগত, হতে পারে অবস্তুগত। আমরা ইচ্ছা করলে সেই কাজ করতে পারি, যা সময়ের অভাবে এত দিন পারিনি। নিজের ভালো লাগা ও প্রতিভাকে সময় দিতে পারি, হতে পারি সেই কল্পনার আমি। আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে আমাদের পরিবার। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমরা তাকে খুব একটা সময় দিতে চাই না বা পারি না। এখন কিন্তু প্রতিটি বিকেলে কফির কাপ হাতে নিয়ে পরিবারের সঙ্গে হয়ে যেতে পারে অতীতের স্মৃতিচারণা। এখনই সময় এখনই সুযোগ। ‘পরিবর্তনই প্রকৃতির ধর্ম’। এটাই সত্য, এটাই দরকার। পরিবর্তন দুই প্রকার, যথা ইতিবাচক ও নেতিবাচক পরিবর্তন। আমরা এই মহামারির সময়ে নিজের মধ্যে কোনো ধরনের পরিবর্তন এনেছি, তার যোগফল হিসেবে প্রতীয়মান হবে মহামারির পর বিশ্ব আমাদের কীভাবে গ্রহণ করবে।
‘জীবনের রং রঞ্জকের রং ন্যায়’ আমরা যখন পৃথিবীতে জন্ম নিই তখন আমাদের জীবনটা সাদা পাতার অবস্থায় থাকে। সে পাতায় আমরা যে রং যে অনুপাতে ব্যবহার করব, তার ওপর নির্ভর করবে আমাদের চিত্রশিল্প কতটা গ্রহণযোগ্য হবে। আমরা যদি অবসরের মরুভূমিতে পানির সন্ধান না করে গড্ডলিকাপ্রবাহের মতো ছুটতে থাকি ট্রল, মিম নামক হালকা এবং অনুৎপাদনশীল কার্যক্রমের দিকে; তাহলে এটাই স্বাভাবিক যে বাস্তবতার রুক্ষরূপে আমাদের পানির অভাবে কাতরাতে হবে। তাই সবার প্রতি উদাত্ত আহ্বান থাকবে এই যে আমরা যেন নিজেদের মধ্যে নিজেদের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসি। মহাকাল আমাদের যে ক্ষুদ্র সময়টা দান করেছে, সেটা আমানতস্বরূপ। আমরা যেন আমানতের খেয়ানত না করি। তাহলেই আমরা একমুখ হাসি এবং একবুক ভালোবাসা নিয়ে জীবনপথে হেঁটে যেতে পারব বহুদূর। রাঙিয়ে দিতে পারব আপন আকাশ। জীবনে জীবন যোগ করে হাসিল করতে পারব জীবনের উদ্দেশ্য।
আশা করি, আমরা সবাই এই মহামারির সময়টাতে নিজেকে খুঁজে নেব নিজের মতো করে। সর্বদা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রেখে এগিয়ে যেতে হবে অনন্তকালের পথে।
*শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ