নদীটি উত্তরাঞ্চলের মানুষের বাসস্থান, কর্মসংস্থান কেড়ে নিয়ে বেকারে পরিণত করছে প্রতিনিয়ত এবং দিশেহারা লাখো মানুষ। তিস্তা নিয়ে ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে স্থীর হয় যে তিস্তা নদীর জলের শতকরা ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৩৯ শতাংশ পাবে ভারত; বাকি ২৫ শতাংশ জল নদীতে সংরক্ষণ রাখা হবে। কিন্তু জল ভাগাভাগি নিয়ে কোনো সুপরিকল্পনা বা দিকনির্দেশনা ছিল না।
২০০৭ সালের ২৫, ২৬, ২৭ সেপ্টেম্বর তিস্তা পানিবণ্টন বৈঠকে ৮০ শতাংশ পানি দুই দেশের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়া এবং ২০ শতাংশ পানি নদীতে সংরক্ষিত রাখার প্রস্তাব দিলে ভারত তাতে অসম্মতি জানায়।
অথচ শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি দেওয়া হয় না এবং বর্ষার মৌসুমে তিস্তার বাঁধ ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন অঞ্চল বন্যার কবলে পড়ে বসতবাড়ি, আবাদি জমি, স্কুল, কলেজ এবং নদীভাঙনসহ ব্যাপক ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে। ফলে প্রতিবছর নদীর দুই পারের ২০ হাজার মানুষ বসতভিটা, আবাদি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। চলমান প্রকল্পের বাস্তবায়নের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি থেকে রেহাই পাবে উত্তরাঞ্চল।
পশ্চিমবঙ্গের আবাদযোগ্য ৯ লাখ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আনতে পারলে কৃষি খাতের উন্নয়ন ঘটবে। নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৬ লাখ হেক্টর জমিকে শুষ্ক মৌসুমে সেচের আওতায় এলে তিস্তার পানি প্রয়োজন প্রতি সেকেন্ড ১৬০০ ঘনমিটার। কিন্তু বর্তমানে উত্তরবঙ্গ পাচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে ১০০-১৫০ ঘনমিটার জল।
উত্তরাঞ্চলের জীবনযাত্রার মান এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই বাংলাদেশ সরকার চীন সরকারকে আহ্বান জানিয়েছিলেন কয়েক বছর পূর্বে।
একসময় চীনের হোয়াংহু নদীকে চীনের দুঃখ বলা হলেও সেটি বর্তমানে চীনের আশীর্বাদে পরিণত করেছে চীনা সরকার। সেই একই কায়দায় বাংলাদেশের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনগণের দুঃখ–দুর্দশা ডেকে আনা তিস্তা নদীকেও আশীর্বাদে রূপান্তর করে কীভাবে একটি বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা যায়, সেটিই ছিল অনুরোধের মূল বিষয়। এখন শুধু দেখার বিষয়, প্রকল্পটির কাজের গতিশীলতার মাধ্যমে শেষ করা।
তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্পটি পরিকল্পনায় থাকছে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমনায় ১১৫ কিলোমিটার তিস্তা নদী খননে গভীরতা বৃদ্ধি করা এবং প্রশস্ততাকে কমিয়ে ফেলা। নদীখননে নদীর গভীরতা বৃদ্ধি করা হলে স্বভাবতই নদীর স্রোত কমে যাবে ফলে, নদীভাঙনের ঝুঁকি তেমন থাকবে না।
নদীভাঙন রোধ হলে প্রতিবছর গড়ে ২০ হাজার মানুষকে বাস্তুহারা ও আবাদযোগ্য জমি হারিয়ে নিঃস্ব হতে হবে না। একই সঙ্গে নদীগর্ভে হারিয়ে যাওয়া ভূমি উদ্ধার করে চাষাবাদের সুযোগ সৃষ্টি করা। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে তিস্তার স্রোতে নদীভাঙনের ফলে যেসব আবাদযোগ্য কৃষিজমি নদীর ভূগর্ভে পতিত হয়েছে, সেগুলো পুনরুদ্ধার করে আবাদ করতে পারলে উত্তরবঙ্গের কৃষি খাতের ব্যাপক উন্নতি ঘটবে। এমনকি আর কোনো আবাদযোগ্য কৃষিজমি নদীগর্ভে যাওয়ার আশঙ্কা না থাকায় উত্তরবঙ্গ কৃষি খাতকে সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রাখবে।
নদীর দুই তীরসংলগ্ন চার লেনের সড়ক তৈরি করে যোগাযোগব্যবস্থাকে উন্নত করা। এতে উত্তরবঙ্গের অভ্যন্তরীণ যাতায়াত এবং সহজে দ্রুততর সময়ে কেন্দ্রীয় শহরে যোগাযোগ রক্ষা সম্ভব হবে। ব্যবসা–বাণিজ্যের উন্নতি ঘটবে এবং কোটি মানুষের যাতায়াতের দুঃখ-দুর্দশা দূর হবে। তা ছাড়া দূরত্ব কমে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা সহজতর হবে। ফলে, ঢাকার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের ব্যবসা–বাণিজ্য নতুন করে যোগসূত্র স্থাপন করে ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক চাকাকে আরও গতিশীল করে তুলবে। এতে উত্তরাঞ্চলের দরিদ্রতার হার ক্রমে হ্রাস পাবে।
বর্ষাকালে প্রবাহিত নদীর বিপুল জলরাশিকে সংরক্ষণ করে নদীর দুই ধারে খাল খননের মাধ্যমে উভয় তীরের এলাকার আবাদযোগ্য জমিতে শুষ্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা গড়ে তোলা। তিস্তা প্রকল্পে শুষ্ক মৌসুমে সেচব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে আর পানির অভাবে অতিখরার কবলে পড়ে লাখো হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হতে হবে না। এমনকি পানির জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতের ওপর নির্ভরশীলও হতে হবে না বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে। নদীর তীরের দুই পাশে সড়কের সঙ্গে নগরায়ণ ও শিল্পায়নের সুবিধা ঘটবে।এতে ৯ থেকে ১০ লাখ মানুষের নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন’ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সত্যি সত্যিই তিস্তা প্রকল্প বাংলাদেশের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনজীবনে ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে একটি যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটাতে সমর্থ হবে। ফলে, উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সমগ্র অর্থনৈতিক চাকাকে আরও গতিশীল করে তুলে উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
*লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
**নাগরিক সংবাদে [email protected] এ লেখা, ছবি ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন