উইকিপিডিয়ার ২০ বছর: আমরা এখন কোথায়?

গত ১৫ জানুয়ারি বিশ্বব্যাপী অনলাইনের বৃহত্তম বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার বিংশ জন্মদিন উদ্‌যাপিত হলো। ২০০১ সালের ১৫ জানুয়ারি যখন ‘যেকেউ অবদান রাখতে পারে’ ধাঁচের পাগলাটে চিন্তা দিয়ে উইকিপিডিয়ার যাত্রা শুরু হলো, সেদিনও কেউ কল্পনা করতে পারেনি, বৈশ্বিক জ্ঞানের রাজ্যে কী ভীষণ পরিবর্তনটাই না আসতে যাচ্ছে! আজ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কাছে উইকিপিডিয়া একটি পরিচিত আর অত্যাবশ্যক নাম, যাকে ছাড়া অনলাইনের লাখো তথ্যের মধ্যে সঠিক আর প্রয়োজনীয় তথ্যটা গুছিয়ে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

২০০১ সালে মার্কিন উদ্যোক্তা জিমি ওয়েলসের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় উইকিপিডিয়া। সঙ্গে ছিলেন ল্যারি স্যাঙ্গার, যিনি এর নামকরণ করেন ‘উইকি’ আর ‘এনসাইক্লোপিডিয়া’ শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে। ‘উইকি’ হলো যৌথভাবে ওয়েবসাইট নির্মাণ-সম্পর্কিত একটি প্রযুক্তিক শব্দ। যেহেতু উইকিপিডিয়া গড়ে উঠবে সবার অবদানের ভিত্তিতেই, তাই এই নাম; আর সঙ্গের ‘পিডিয়া’ তথা এনসাইক্লোপিডিয়া হলো বিশ্বকোষ। তবে এই ওয়েবসাইটে থাকবে না কোনো বিজ্ঞাপন, থাকবে না কোনো ফি, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার মতো মুদ্রিত বই ক্রয়ের জন্য যে মোটা অঙ্কের অর্থ প্রয়োজন, সেটাও দরকার হবে না। যেকেউ বিনা মূল্যে প্রয়োজনীয় তথ্য আহরণ করতে পারবেন, আর পুরো প্রকল্প চলবে মানুষের দানে। মূলমন্ত্র ছিল সহজ: ‘ভাবুন তো এমন এক পৃথিবীর কথা, যেখানে সমস্ত জ্ঞানে সব মানুষের থাকবে অবাধ প্রবেশাধিকার।’ শুরুর পর থেকেই দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে ইংরেজি উইকিপিডিয়ার নিবন্ধের সংখ্যা। প্রথম এক বছরের মাথায় ইংরেজি উইকিপিডিয়ায় নিবন্ধ সংখ্যা গিয়ে ঠেকল ২০ হাজারের ওপরে। এর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে অন্য ভাষাভাষীদের মোটেও দেরি হলো না। খুব শিগগিরই জার্মান, কাতালান ও জাপানি ভাষায় চালু হলো উইকিপিডিয়া। আমাদের মাতৃভাষাও বা পিছিয়ে থাকবে কেন? একদল ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো মানুষের উদ্যোগে ২০০৪ সালের ২৭ জানুয়ারি চালু হয় বাংলা উইকিপিডিয়া (https://bn.wikipedia.org/)। আজ বিশ্বের ৩০০-টিরও বেশি ভাষায় বিদ্যমান উইকিপিডিয়া, যেখানে সাড়ে পাঁচ কোটিরও বেশি নিবন্ধ রয়েছে। প্রতি মাসে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা দেড় শ কোটিরও বেশি মানুষ স্বতন্ত্র ডিভাইসের মাধ্যমে উইকিপিডিয়া থেকে তথ্য আহরণ করে থাকেন। বিশ্বের যেকেউ স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে অবদান রাখতে পারেন অনলাইনের বৃহত্তম এ জ্ঞানের ভান্ডারে। জীবনী, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, ইতিহাস, শিল্পকলা, সংস্কৃতি সহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখা সম্পর্কেই তথ্য রয়েছে এখানে।

স্কুল পর্যায়ের কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা। ছবি: মতিউর রহমান

ইন্টারনেটের প্রসার ক্রমাগত বাড়লেও নির্ভরযোগ্য তথ্যের উৎস খুব একটা বাড়েনি। এমন এক পরিবেশে উইকিপিডিয়া রীতিমতো বিপ্লব ঘটাল, সে দারুণভাবে প্রয়োজনীয় রেফারেন্স বা তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে তথ্যগুলোকে উপস্থাপন করতে লাগল। এখানে যেকেউ অবদান রাখতে পারবে, তবে প্রয়োজনীয় তথ্যসূত্র দিতে হবে। সেটা হতে পারে বই, বিশ্বাসযোগ্য সংবাদপত্র বা অনুরূপ কিছু। উইকিপিডিয়ার স্বেচ্ছাসেবকেরা তথা উইকিপিডিয়ানেরাই এই তথ্য যুক্ত করেন, তাঁরাই যাচাই করেন অন্যের যুক্ত করা তথ্য ঠিক আছে কি না।

আর তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা? প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় বিশ্বখ্যাত জার্নাল নেচারে প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে বলা হয় ইংরেজি উইকিপিডিয়ার সঠিকতা এই অল্প কয় দিনেই এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সমকক্ষ হয়ে উঠেছে। উইকিপিডিয়ার সব তথ্য সঠিক, এটা কেউ দাবি করে না। তবে সে রকম চিন্তা করলে ভুল কোথায় না থাকে! সব তথ্য যাচাইযোগ্য, এই বৈশিষ্ট্যই উইকিপিডিয়াকে এত গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।

কিন্তু উইকিপিডিয়ার কার্যাবলি কি কেবল অনলাইন বিশ্বকোষ হিসেবেই থেমে আছে?

না, নিছক একটা অনলাইন ওয়েবসাইট হিসেবে চালু হলেও এখানেই উইকিপিডিয়া থেমে নেই। মানুষের আস্থা দারুণ এক দায়িত্বশীল অবস্থানে নিয়ে গেল উইকিপিডিয়াকে। ওয়েবসাইট ও এ সংশ্লিষ্ট সবকিছুকে কাঠামোবদ্ধভাবে চালিয়ে নেওয়া, বিশ্বব্যাপী উন্মুক্ত জ্ঞান আরও কার্যকরভাবে ছড়িয়ে দিতে ২০০৩ সালে উইকিপিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতার হাত ধরেই তৈরি হয় অলাভজনক সংস্থা উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন। একে একে উইকিপিডিয়ার মতো আরও প্রকল্প তৈরি হতে থাকে। এ সবকিছুকে একত্রে ‘উইকিমিডিয়া’ নামের আওতায় নিয়ে আসা হয়। বিশ্বব্যাপী মানুষের কাছে আরও বৃহত্তর উপায়ে পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে অ্যাফিলিয়েটদের স্বীকৃতি দেয় ফাউন্ডেশন। বাংলাদেশে উইকিপিডিয়া ও এ–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রকল্পের উন্নয়ন ও মানুষকে জানানোর জন্য ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অলাভজনক সংস্থা উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ। এই সংস্থার স্বেচ্ছাসেবকেরা কর্মশালা, প্রতিযোগিতা প্রভৃতির মাধ্যমে বাংলা উইকিপিডিয়া ও এর সহপ্রকল্পের উন্নয়নের জন্য সচেষ্ট থাকে, যেন আরও মানুষ জানতে পারে ও নিজ ভাষায় জ্ঞানের মাধ্যম তৈরিতে অবদান রাখতে পারে।

আজ সাধারণ এক অনলাইন বিশ্বকোষের চিন্তা পৌঁছে গেছে অন্য এক মাত্রায়। বিশ্বের সবার জন্য বিনা মূল্যে জ্ঞান পৌঁছে দেওয়াই এখন উইকিমিডিয়া কার্যক্রমের লক্ষ্য। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে উন্মুক্ত জ্ঞানের বাস্তুতন্ত্রের অত্যাবশ্যক অংশ হবে উইকিমিডিয়া। এখন নিশ্চিত করার পালা, যেন এই লক্ষ্যে বিশ্বাসী সবাই উইকিমিডিয়া কার্যক্রমের অংশ হতে পারে। সে লক্ষ্য পূরণ করার জন্য বিশ্বব্যাপী স্বেচ্ছাসেবকেরা ভালোবেসে কাজ করছেন, গড়ে তুলছেন জ্ঞানের বিশাল এক রাজ্য।
বাংলাদেশে বিগত দশকে ইন্টারনেটের অচিন্তনীয় প্রসার ঘটেছে। আজ থেকে কয়েক দশক আগেও গ্রাম, উপজেলা, এমনকি জেলা পর্যায়েও সহজে সব তথ্য পাওয়ার অবকাশ ছিল না, আজও সর্বত্র সমানসংখ্যক গ্রন্থাগার নেই। কিন্তু আছে উইকিপিডিয়া, যার মাধ্যমে সমান সুযোগ নিয়ে যেকেউ তথ্য পেতে পারেন—সে রাজধানীতেই থাকুন বা গ্রামে। এই সুযোগ ব্যবহার করে আমাদেরও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশাল যে আন্দোলন বিশ্বব্যাপী চলছে, তার অংশ হয়ে উঠতে হবে। নিজ ভাষায় উইকিপিডিয়াকে গড়ে তোলার মাধ্যমেই সেটা শুরু হতে পারে। গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর বাংলা উইকিপিডিয়ার নিবন্ধ সংখ্যা এক লাখ অতিক্রম করে। এটা আমাদের জন্য আনন্দের হলেও মনে রাখতে হবে, ইংরেজি উইকিপিডিয়ার নিবন্ধ সংখ্যা ৬২ লাখেরও বেশি। অর্থাৎ, আমাদের এখনো যেতে হবে বহুদূর।

আমাদের ভাষার উইকিপিডিয়াকে গড়তে হবে আমাদেরই। বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী সুবিশাল, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বিশাল। নিত্যদিনের ক্ষুদ্র অংশ বাংলা উইকিপিডিয়াকে দিলেও আমরা অনেক এগোতে পারব। তাই উইকিপিডিয়ার ২০তম জন্মদিনের এ ক্ষণে আপনাদেরকে আমন্ত্রণ জানাই, আসুন, বাংলা উইকিপিডিয়াকে সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে প্রিয় মাতৃভাষাতেই সবাই সমানভাবে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন করতে পারার স্বপ্নটাকে সত্যি করে তুলি।

*লেখক: অংকন ঘোষ দস্তিদার, উইকিপিডিয়ার স্বেচ্ছাসেবক। শিক্ষার্থী, চতুর্থ বর্ষ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।