ঈদের শাড়ি
চাচাতো ভাইয়ের শাড়ির দোকান শহরে। ঈদ উপলক্ষে প্রচুর বেচাকেনা হচ্ছে। আমাকে দোকানে রেখে সে বাসায় গেছে ঘণ্টাখানেক আগে। যাওয়ার আগে বলে গেছে, দোকানের সবচেয়ে দামি শাড়ির মূল্য হচ্ছে পাঁচ হাজার টাকা। পাঁচ হাজারের ওপরে যা বিক্রি করবি, সব তোর।
দোকানে একা একা বসে আছি। হঠাৎ এক আন্টি এলেন। পুরো দোকান ঘুরে ঘুরে দেখলেন। আমি বললাম, আন্টি, কিছু লাগবে?
কী আছে তোমার দোকানে?
সুই-সুতা থেকে শুরু করে সব আছে।
কয়েকটা দামি শাড়ি দেখাতে পারবে?
কী বলেন! দেখাতে পারব না মানে। এই সবই তো আমাদের কাজ। বসেন আন্টি, চেয়ার টেনে আরাম করে বসেন।
দোকানের কর্মচারী রফিকুল ইসলামকে ডেকে বললাম, এই রফিক, কই তুই? আন্টির মাথার ওপর ফ্যানটা ছাইড়ে দে। আন্টি এক্কেবারে ঘামায় গেছে। আন্টি, অনেক দোকান ঘুরলেন মনে হচ্ছে, তাই না?
হ বাবা। পুরো মার্কেট ঘোরাঘুরি করেও পছন্দমতো শাড়ি পাইলাম না।
পাইবেন না আন্টি। বাজারের মধ্যে সব চেয়ে বড় পাইকারি দোকান আমাদের। দেখেন কোনটা লাগবে দেখেন। ভালো করে দেখেন। পুরো দোকান আপনের সামনে রাখলাম। কিনতে বলব না, আপনে আমার মায়ের মতন। শাড়িতে হাত বুলিয়ে দুয়া দিয়ে যান।
কী যে বলো না বাবা। তোমার কথাবার্তা শুনে যারপরনাই খুশি হয়েছি। আরও দোকানদার দেখলাম, তোমার মতো একটা দোকানদারও পাইলাম না।
আন্টি, আমি কিন্তু লজ্জা পাইতাছি। এই রফিক, আন্টির জন্য এক লিটারের সেভেনআপের বোতল নিয়ে আয়।
আল্লাহ আল্লাহ, আমি তো রোজা রেখেছি।
আন্টি রোজা তো আমরাও রাখছি। এটা আমার পক্ষ থেকে উপহার। ইফতারির পর খাইয়েন।
এমন সময় আন্টির মেয়ে দোকানে ঢুকল। মা, তোমাকে সারা মার্কেট তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। কোথাও পেলাম না। তুমি এখানে বসে আছো? চলো। কয়েক দিন পর আসবনি আবার।
আপামণি অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছেন। আন্টির সঙ্গে একটু বসেন। শাড়িই তো নেবেন। আর তো কিছু না। পুরো দোকানের দামি দামি শাড়ি আপনাদের সামনে রাখা আছে। পছন্দ হলে নেবেন, না হলে নেবেন না। কেউ কিছু বলবে না।
চেহারা দেখে মনে হলো একটু হলেও মন গলে গেছে।
ভাইয়া, ওই সবুজ রঙের শাড়িটা দেখান।
এটা?
না, না। লালটার পাশেরটা। হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিকাছে।
এই যে দেখেন, ভেতরে ঘর ঘর ছাপা। শাড়ির পাড় মাশা আল্লাহ মজবুত। শাড়িটা ধইরেই দেখেন। পরতে আরামদায়ক হবে। আন্টি তো সব সময় পরে। আন্টিই ভালো বলতে পারবে, কী কন আন্টি?
ভাইয়া, ওই যে লাল রঙের শাড়িটা দেখান।
এই যে লন, লাল রঙের শাড়ি। সত্যি কইরে একটা কথা কই আপা, এই শাড়িটা আপনে পরলে পুরাই জোশ লাগবে। মনে হবে যে শান্তশিষ্ট একটা টকটকে লাল রঙের গোলাপ ফুল ফুইটে আছে। কী রে রফিক, ঠিক কইছি না?
হ ভাই, খুব মানাইব আপারে।
আন্টি বলল, থাক বাবা, এত কষ্ট করে আর শাড়ি নামানোর দরকার নেই। এই দুইটা শাড়িই পছন্দ হয়েছে।
কী কন আন্টি! কষ্টের কী আছে। আপনে শাড়ি না নিয়ে চলে গেলেও খুশি হব। আপনেরে আর একটা শাড়ি দেখামু, এটাই শেষ। কথায় আছে না, শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। এই যে এই খয়েরি রঙের শাড়িটা লন। কারুকার্যময়। এটা আন্টি সবাইকে দেখাই না। আপনারা আমার পরিচিত মানুষ, কাছের মানুষ, এই জন্যই দেখাচ্ছি। সবাই কিন্তু এই শাড়ি নিতেও পারবে না, বুঝলেন?
আপা শাড়িটা আন্টির গায়ে একটু জড়িয়ে ধরেন তো। এই তো। আন্টি আপনাকে যা লাগছে না। মনে হইতাছে আপনের বয়স থেকে ১০ বছর কমে গেছে। হা হা।
আন্টি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললেন, এটাও প্যাক করে দাও।
আপা আপনেরে আর একটা শাড়ি দেখাই? নেওয়া লাগবে না খালি দেইখে যান। এই যে এটা লন, হাত দিয়ে ধরেই দেখেন।
না, ভাইয়া এটা ভালো লাগছে না।
খুশি হইলাম আপা। ভালো লাগছে না, কী সুন্দর করে কইয়ে দিলেন। অনেক কাস্টমার কী করে জানেন? ভালো লাগছে না বইলে চইলে যায়। এটা কিন্তু ঠিক না, তোর ভালো লাগছে না তুই আরও দ্যাখ, দেখতে দেখতে ক্লান্ত করে দে দোকানদারদের।
আপা, আপনের কোন ধরনের শাড়ি দেখাব খালি কন?
পিংক কালারের মধ্যে অফ হোয়াইট।
এই তো আপা এতক্ষণে আনকমন একটা শাড়ি রঙের কথা কইছেন। শাড়ি সম্পর্কে আপনার বিরাট জ্ঞান আছে দেখছি। শাড়িটা আছে। দেওয়া যাবে। তয় দামটা একটু বেশি দেওয়ান লাগবে। কারণ, পিংক হইলো গিয়ে ফ্যাকাশে লাল রং, যার নামটা আইছে পিংক ফুল থেকে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের জরিপগুলোয় দেখা গেছে যে মাধুর্য, বিনয়, সংবেদনশীলতা, নাজুকতা, কমনীয়তা, শৈশব, নারীত্ব ও রোমান্টিক ভাব বোঝাতে পিংক রংটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। আর এই রংটা নারীরাই বেশি ব্যবহার করে। বুঝলেন?
এই রফিক, গোডাউন থেকে পিংক কালারের এক ডজন শাড়ি নিয়ে আয়। কুইক।
এই যে লন আপা। আপা, এটা পরলে আপনেরে রাঙা বউয়ের মতো লাগব। আচ্ছা আপা, আপনে কি ‘রাঙা বউ’ উপন্যাসটা পড়েছেন?
জি না ভাই। আমি বইটই বেশি একটা পড়ি না।
জানেন, এই উপন্যাসটা লেখার কথা ছিল আমার।
তাই নাকি? তো লিখলেন না ক্যান?
এই দেখেন না, শাড়ি বেচাকেনার যে ধুম চলতাছে। হিসেব কইরেই কূল পাই না, উপন্যাস লেখব কোন সময়?
আন্টি বললেন, বাবা, সব কটি প্যাক করে দাও। কত টাকা হলো, বলো। দামটাম একটু কম করে ধইরো।
আন্টি, দামের চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। আমি এতক্ষণ বইসে বইসে চিন্তা করছি।
আমি আপনাদের কাছ থেকে এক পয়সাও বেশি রাখব না। আপনাদের মোট বিল হচ্ছে গিয়ে ৪১ হাজার ৯৩ টাকা ১৯ পয়সা।
আরেকটু কমানো যায় না?
না আন্টি, ব্যবসায় লাল বাত্তি জ্বলে উঠবে।
তারপরও দেখো একটু। চার-চারটা শাড়ি নিলাম একসঙ্গে।
আন্টি, আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে ১৯ পয়সা কমিয়ে দিলাম। আর কমাইতে বইলেন না। বিরাট লস হয়ে যাবে।
আমার মাইয়্যার মুখের দিকে তাকিয়ে আরেকটু কমানো যায় না?
এত করে যখন কইতাছেন যান, কী আর করার। ৯৩ টাকা কমিয়ে দিলাম। বরাবর ৪১ হাজার টাকা দেন। তারপরও আপনারা খুশি থাকেন। ঈদের পর আবার আইসেন, দাম কমটম রাখবনি।