ইশ! যদি শৈশবে ফেরা যেত
প্রত্যেক মানুষের কাছে শৈশবের স্মৃতিই সবচেয়ে মধুর, আনন্দের। কাদামাটিতে পুরো শরীর মেখে রাখা, আইসক্রিমওয়ালার, বায়োস্কোপওয়ালার পেছনে দৌড়ানো। সাপুড়ের সাপের খেলা দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা। ধানখেতের আইল ধরে ঘুড়ি নিয়ে দৌড়ানো। মার্বেল আর লাটিম খেলায় সারা দিন পার করে দেওয়া। দিন শেষে মার কাছে বকুনি খেয়ে ঘরে ফেরার স্মৃতিগুলোই আমাদের সবচেয়ে প্রিয়। সময় পাল্টায়, জীবনধারা পাল্টায়, শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, যৌবন থেকে বৃদ্ধ—সব কালেই আমাদের মানসপটে শৈশবের স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায়।
আমাদের গ্রামে সপ্তাহে দুই-তিন দিন ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে মাথায় লাল টুপি পরে, কার্টুনের মতো সেজেগুজে কাঁধে অন্য রকম এক বাক্স নিয়ে মধ্যবয়সী এক লোক আসতেন। ছেলেবেলায় ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি যে বাক্সটির নাম কী। তবে বাক্সের ঠিক মাঝ বরাবর একটা বড় ফুটো থাকত। আমরা ফুটো দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতাম তাজমহলের ছবি, পাহাড়ের ছবি, উঁচু উঁচু দালানের ছবি, নায়ক-নায়িকাদের ছবি। ভাবতাম, এটা বুঝি জাদুর বাক্স। আর সে জাদুর বাক্সের নাম বায়োস্কোপ। আমাদের গ্রামে তখনো বিদ্যুৎ আসেনি, আসেনি টেলিভিশন কিংবা মুঠোফোন৷ আমরা বিনোদনের জন্য বায়োস্কোপ দেখার অপেক্ষার প্রহর গুনতাম। নব্বইয়ের দশকের শৈশবজুড়ে একটা বড় অংশ ছিল বায়োস্কোপ।
মাঝেমধ্যে বেদের মেয়েরা আসত দল বেঁধে সাপের খেলা দেখাতে। ছোট ছোট বাক্সে ভরে নিয়ে আসত সাপ। নানান ভঙ্গিতে সাপের খেলা দেখাত, আমরাও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। তখন এক টাকা দিয়ে পাওয়া যেত চার থেকে পাঁচটি চকলেট, গোল গোল বাবুল বিস্কুট ছিল সবার পছন্দের শীর্ষে। বাবুল বিস্কুট এক টাকা দিয়ে পাওয়া যেত চার পিস।
পুরোনো বোতল, টিন, লোহা দিয়ে ফেরিওয়ালা সিদ্ধ বুট আর কুলফিমালাই আইসক্রিম বিক্রি করতে আসতেন। তখন মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘর থেকে নানান কিছু নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে সেদ্ধ করা বুট, আইসক্রিম, হাওয়াই মিঠাই কিনে খেতাম। মাঝেমধ্যে মার কাছে ধরা পড়ে যেতাম। আর বিভিন্ন ফন্দিফিকির খুঁজতাম, কীভাবে মিথ্যা বলে পাড় পাওয়া যাবে। বেশির ভাগ সময়ই সফল হতে পারতাম।
বন্ধুরা, বাড়ির চাচাতো ভাইবোন সবাই মিলে খেলতাম জোলাপাতি। কারও ঘর থেকে চাল, কারও ঘর থেকে ডাল, কেউবা শাকসবজি নিয়ে আসত। নিজেরাই রান্না করতাম ছোট্ট মাটির চুলায়। সে চুলা নিজেরাই তৈরি করতাম। রান্না শেষ হলে খোলা আকাশের নিচে উঠানে বসে খেতাম সবাই মিলে। বিশেষ করে বৈশাখ মাসে জোলাপাতি খেলা হতো প্রচুর।
বৈশাখ মাসে ঝড়ের সময়টা ছিল অনেক আনন্দের। গাছে গাছে আমের মুকুল। আমের গুটি একটু বড় হওয়া শুরু করলেই তখন আমাদের মনে ছটফট শুরু হতো। কখন ঝড় হবে, কখন আম কুড়াতে যাব। ঝড় শুরু হলে কোনো রকমে মায়ের চোখ ফাঁকি দিতে পারলেই হলো, দৌড়ে চলে যেতাম গাছতলায়। বন্ধুরা মিলে বৃষ্টিতে ভিজে আম কুড়াতাম। ঝড় থেমে গেলে কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরতাম, মা দরজার সামনে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। নানান প্রশ্ন করতেন, কেন গেছি বাইরে, ঝড়-তুফান কোনো কিছু বাছবিচার করি না। কোনো উত্তর দিতাম না, ভয়ে কাঁপতাম শুধু। পরক্ষণেই মা আঁচল দিয়ে মাথাসহ পুরো শরীর মুছে দিতেন।
ঝড়ের সময় নারকেলগাছ থেকে শুকনো পাতার ডাল মাটিতে পড়ে যেত। আমরা শুকনো পাতার ডালকে বানিয়ে ফেলতাম ‘গাড়ি’। একজন এক মাথায় বসতাম আর অন্য আরেকজন সামনে থেকে টেনে নিয়ে যেত। পালা করে সবাই বসার সুযোগ পেতাম। শৈশবের প্রথম গাড়িতে চড়া ছিল ‘নারকেল পাতার গাড়ি’। দুপুর হলেই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘনা নদীতে বন্ধুরা, চাচাতো ভাইবোন মিলে দৌড়ে পানিতে পড়তাম, লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপিই ছিল আমাদের গোসল। পানিতে তখন ছোঁয়াছুঁয়ি, বরফ-পানি খেলতাম। একজন সবাইকে ধরবে, আর বাকি সবাই পালিয়ে থাকবে। যাকে প্রথম ধরতে পারবে, সে তার সঙ্গে যোগ হয়ে বাকিদের ধরবে। খেলতে খেলতে চোখ-মুখ পানিতে লাল করে ফেলতাম। দৌড়ে মা আসতেন লাঠি নিয়ে, কারণ মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়েই তো এতটা সময় পানিতে থাকা।
সন্ধ্যা হলেই শুরু হতো আমাদের খেলার আরেক পর্ব, লুকোচুরি খেলা। পাড়ার সব ঘরই ছিল আমাদের লুকোচুরি খেলার জায়গা। বিশ শতকের শুরুর দিকে এলাকায় বিদ্যুৎ আসে। তখন লুকোচুরি খেলতাম। অপেক্ষায় থাকতাম সন্ধেবেলা কখন বিদ্যুৎ চলে যাবে। বিদ্যুৎ চলে যেতে দেরি, আমরা হই-হুল্লোড় করে ঘরের বাইরে বের হয়ে আসতাম, আবার বিদ্যুৎ আসলে হই-হল্লা করেই ঘরে ফিরতাম।
গ্রামে তখনো তেমন করে টেলিভিশনের ছোঁয়া লাগেনি। পুরো গ্রামে দু-একটা টেলিভিশন ছিল। আমার চাচার বাসায় তখন টেলিভিশন আনে। বাংলা সিনেমার তখন স্বর্ণযুগ চলে। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবি দেখার জন্য পাগল সবাই। সবাই এতটাই উৎসুক ছিল যে শেষমেশ টেলিভিশনের জায়গা হয় বাড়ির উঠানে। বাড়ির সবাই একসঙ্গে মাটিতে বসে টেলিভিশন দেখতাম তাও আবার বিকেলে বা সন্ধ্যায়। আশপাশের অনেক বাড়ি থেকেও দেখতে আসত। মাঝেমধ্যে আমার ওপর এন্টেনা ঠিক করার দায়িত্ব পড়ত। একটু নাড়িয়ে দিলেই পরিষ্কার টেলিভিশন চলত। কেউ এন্টেনা ঠিক করার দায়িত্ব নিত না, সবার চোখ তখন টেলিভিশনের পর্দায়। প্রতি শুক্রবার ছিল আমাদের বিশেষ দিন, ধারাবাহিকভাবে হতো ‘আলিফ লায়লা’, হানিফ সংকেতের ‘ইত্যাদি’, ‘হাতিম’। সবাই অপেক্ষায় থাকতাম কবে শুক্রবার আসবে, মনে হতো ইশ! প্রতিদিনই যদি শুক্রবার হতো। কেউ কোনো কারণে কোনো অনুষ্ঠান বা ছবি মিস করলে পরদিন সবাই ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা করত।
মুঠোফোন তখন আজকের মতো এত সহজলভ্য হয়নি। দুই-তিন গ্রামে একটা মুঠোফোন পাওয়াও ছিল মিরাকল। তখন যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল ডাকযোগে চিঠি। সে সময় বাবা সংসারের টানাপোড়েনে পাড়ি জমান প্রবাসে। বাবার সঙ্গে প্রতিদিন যোগাযোগ করার কোনো সুযোগ ছিল না। মাসে-দু মাসে একটা চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করি। তখন মা রাতের বেলা চিঠি লিখতেন আর আমরা ভাইবোন সবাই মার পাশে বসে থাকতাম। ডাকে চিঠি দেওয়ার পর অপেক্ষায় থাকতাম, কবে চিঠির উত্তর আসবে। যখন চিঠির উত্তর আসত মাসখানেক পর, তখন আনন্দে চোখে পানি চলে আসত। মাঝেমধ্যে কেউ প্রবাস থেকে এলে বাবা টেপরেকর্ডারে কথা রেকর্ড করে পাঠাতেন আর আমরা সারা দিন একটু পরপর বাবার কথাগুলো শুনতাম। তারপর আমরাও টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করে সেই ক্যাসেট পাঠাতাম। সেই যে চিঠির, টেপরেকর্ডারের অপেক্ষার এক তীব্র প্রহর এখনো মনে পড়ে।
এখনো সেই শৈশবের স্মৃতিগুলো হাতড়ে বেড়াই। স্মৃতির মানসপটে এখনো ভেসে ওঠে আমার শৈশব, কৈশোর। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে যারা শৈশব আর কৈশোর পাড় করেছে, তারাই দেখেছে নতুন বিদ্যুতের বিপ্লব, টেলিভিশনের পর্দায় ঝলক, মুঠোফোনের আবির্ভাব। দেখেছে সভ্যতার এক নতুন দিক। সেই স্মৃতিগুলো ভুলে যাওয়ার নয়, মুছে ফেলার নয়। বারবার আমরা ফিরে যাই আমাদের শৈশবের, কৈশোরে, স্মৃতির মানসপটে ভেসে ওঠে নব্বইয়ের স্মৃতি। আর অজান্তেই বলে ফেলি, ইশ! যদি আরেকবার যাওয়া যেত হারানো শৈশবে।
শিক্ষার্থী: সরকারি তিতুমীর কলেজ