আমি তোমাকে ভয় করি না তবে...

কাঙাল হরিনাথ। আসল নাম হরিনাথ মজুমদার। ভারতের গ্রামীণ সাংবাদিকতার জগতে প্রথম সফল কান্ডারি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯ শতকে বাংলার হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে সত্য এবং তথ্যঋদ্ধ সাহসী গ্রামীণ সাংবাদিকতার আদি ও প্রবাদপুরুষকে আমরা এ প্রজন্ম অনেকেই জানি না। তাঁর ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ ছিল সে সময় ভারতের তমসাচ্ছন্ন গ্রামজীবনের কণ্ঠস্বর। কাঙাল হরিনাথ কুষ্টিয়ার (পূর্বের নদীয়া জেলা) কুমারখালী উপজেলার কুন্ডুপাড়ায় ১৮৩৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৬ এপ্রিল ১৮৯৬ সালে এ ক্ষণজন্মা লেখক, সাংবাদিক, সংগীতব্যক্তিত্ব ও শিক্ষানুরাগী পরলোকগমন করেন।

কাঙাল হরিনাথ অত্যন্ত গরিব ছিলেন। কুমারখালীতে অনেক নীলকুঠি ছিল। কিছুদিন নীলকর সাহেবের কাছে কাজ করেছিলেন হরিনাথ। কিন্তু নীলচাষিদের ওপর অত্যাচার দেখে সেটাও ছেড়ে দেন। চাকরি ছাড়ার পর মনোযোগ দিয়ে গ্রামীণ সাংবাদিকতা শুরু করেন। মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত সেটাই করে গেছেন। কাঙাল হরিনাথের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা একেবারে কম নয়; ১৮টি। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে ‘বিজয় বসন্ত’ (১৮৫৯), ‘চারু-চরিত্র’ (১৮৬৩), ‘কবিতা কৌমুদী’ (১৮৬৬), ‘বিজয়া’ (১৮৬৯), ‘কবিকল্প’ (১৮৭০), ‘অক্রুর সংবাদ’ (১৮৬৩), ‘সাবিত্রী নাটিকা’, ‘চিত্তচপলা’ (১৮৭৬), ‘মাতৃমহিমা’ (১৮৯৬), ‘কাঙ্গাল-ফিকির চাঁদ ফকিরের গীতাবলী’ (১২৯৩-১৩০০ বঙ্গাব্দ) উল্লেখযোগ্য।
কাঙাল হরিনাথ ছিলেন একাধারে সাহিত্যশিল্পী, সংবাদ-সাময়িকপত্র পরিচালক, শিক্ষাব্রতী, সমাজসংস্কারক, সাধক ও ধর্মবেত্তা। দারিদ্র্যের কারণে হরিনাথ পড়াশুনা বেশি দূর চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু শিক্ষার প্রসারে তিনি ছিলেন সদা সচেষ্ট। তিনি ‘কাঙাল ফকির চাঁদের দল’ নামে একটি বাউল দল তৈরি করেন। ‘কাঙাল ফকিরচাঁদ ফকিরের জীবনী’ নামে একটি বাউল গানের সংকলন প্রকাশ করেন। সাংবাদিকতা বা লেখালেখি করেছেন ঈশ্বরগুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’–এর মতো পত্রিকায়। সম্পাদনা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র মাধ্যমে। সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন লেখনীর মাধ্যমে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। বলা যায়, সমাজসংস্কারক হিসেবেও তিনি সফল। তাঁর সংবাদপত্রে তিনি এক দিকে যেমন মেয়েদের ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের দাবি তুলেছেন দিনের পর দিন; অন্য দিকে জমিদার, নীলকর, মহাজন ও পুলিশের অত্যাচারের বাড়াবাড়ির কাহিনি সাহসের সঙ্গে তাঁর সংবাদপত্রে প্রচার করে গিয়েছেন। তাঁর গ্রামে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। গ্রামীণ সংবাদপত্রে সতীদাহের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন। সারা জীবন অবহেলিত গ্রাম–বাংলায় শিক্ষা বিস্তারের জন্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের মাধ্যমে আন্দোলন করেছেন তিনি।

কাঙাল হরিনাথের পথ ধরে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা (বিশেষ করে গ্রামীণ সাংবাদিকতা) এগিয়ে চলেছে। কিন্তু তাঁকে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করছি! দুর্ভাগ্য আমাদের, হরিনাথকে অন্ধকার থেকে আলোয় আনার খুব কম চেষ্টা দেখি। উনিশ শতকের সামাজিক আন্দোলনে কাঙাল হরিনাথের ভূমিকা বিচার বা মূল্যায়ন করে দেখার সময় এসেছে বলে মনে করি। তাঁকে নিয়ে দুই বাংলার অনেক কলমযোদ্ধা আপ্লুত; পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট কলমযোদ্ধা প্রফুল্ল কুমার সরকার বলেছিলেন, কাঙাল হরিনাথের নাম নব্য বাংলার ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষায় হরিনাথ ছিলেন দৃঢ়সংকল্প। ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্টের প্রতিবাদে তিনি লেখেন, ‘সংবাদপত্র আমাদিগের ব্যবসা নহে। তবে প্রজা কাঁদে, সেই ক্রন্দন লইয়া রাজদ্বারে ক্রন্দন করি, ভাবি রাজপুরুষগণ শুনিলে, প্রজা আর কাঁদিবে না। তাহাদের কাঁদিবার কারণ দূর হইবে। এ জন্য প্রতিবৎসর ক্ষতি স্বীকার করিয়াছি এবং উৎকট রোগের আধার হইয়া যন্ত্রণা ভোগ করিতেছি। যার জন্য, যাঁর প্রজার জন্য কাঁদি, তিনি তাঁর বিলক্ষণ পুরস্কার প্রদান করিলেন। অতএব আর কাঁদিব না।’Ñ(গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা, ১৩-৩-১৮৭৮)। হরিনাথ ছিলেন আপসহীন। তিনি ঠাকুর পরিবারের কৃষক-প্রজাবিরোধী আচরণের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। এ জন্য একাধিকবার তাঁকে আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে। কথিত আছে, ঠাকুর পরিবারের লাঠিয়াল বাহিনী কাঙাল হরিনাথকে আক্রমণ করলে লালন ফকিরের দলবল তাঁকে রক্ষা করেছিল। অক্ষয়কুমার মৈত্র বলেছিলেন, ‘হরিনাথ যাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া সুতীব্র সমালোচনায় পল্লী-চিত্র বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, তিনি এ দেশের সাহিত্য-সংসারে এবং ধর্ম্মজগতের চিরপরিচিত। তাঁহার নামোল্লেখ করিতে হৃদয় ব্যথিত হয়, লেখনী অবসন্ন হইয়া পড়ে।’
পাবনা কৃষক বিদ্রোহের সময় কলকাতার সোমপ্রকাশ, অমৃতবাজার পত্রিকা প্রজাদের নেয়নি, কিন্তু গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা অসহায় প্রজাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। পাবনার কৃষক বিদ্রোহকালে তাঁকে জমিদারবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও হরিনাথ জানান, ‘গ্রামবার্ত্তা জমিদার কি প্রজা— কাহারও স্বপক্ষে বা বিপক্ষে নহে। অত্যাচার ও অসত্যের বিরোধী’। পাবনার ইংরেজ ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট একবার এক দরিদ্র বিধবার একটি দুগ্ধবতী গাভি জবরদস্তি করে সংগ্রহ করে। হরিনাথ সেই অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করে ‘গরুচোর ম্যাজিস্ট্রেট’ নামে সংবাদ প্রকাশ করেন। অধিকার আদায় ও সত্য প্রকাশে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা ও কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের রয়েছে বলিষ্ঠ ভূমিকা। গ্রামবার্ত্তা পত্রিকায় তৎকালীন সময়ে ‘গরুচোর ম্যাজিস্ট্রেট’ শিরোনামে সংবাদ ছাপা হওয়ার পর ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকা সম্বন্ধে তৎকালীন পাবনা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট (সে সময় কুমারখালী ছিল পাবনা জেলার মহকুমা) মি. হামফ্রে তাঁর চিঠিতে কাঙাল হরিনাথ বরাবর চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘মি. এডিটর, আমি তোমাকে ভয় করি না বটে, তবে তোমার লেখনী পড়ে অনেক কুকর্ম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি।’
*লেখক: কবি