এক খিলি পান

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কলেজের গেট থেকে বের হওয়ার আগে এদিক-সেদিক ঘুরে দেখে নিলাম। নাহ্‌, কোথাও কেউ নেই। আশপাশে দারোয়ান থাকার কথা, কিন্তু আজ নেই।

দারোয়ানের জায়গায় দুইটা খাসি ছাগল বাঁধা। তারা একজন আরেকজনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ম্যা ম্যা করছে। বের হব, এমন সময় কাঁধে কারও স্পর্শ অনুভব করলাম। পেছন ফিরে দেখি আমাদের মোকতার, দারোয়ান চাচা।
কই যাও?

এই তো, একটু বাইরে যাই। নিশ্বাস ফেলতে। ভেতরে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে গেছে।

গেট পাস দিয়ে তারপর যাও।

আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম, কেউ দেখছে কি না? নাহ্‌, কেউ দেখছে না। তাহলে হঠাৎ চাচা এত কঠিন ব্যবহার করছেন কেন?
চাচা, দুই দিন আগে না হাকিমপুরী জর্দা দিয়ে একটা পান খাওয়ালাম আপনাকে? এত তাড়াতাড়ি ভুইলে গেলেন!

চাচা ধমক দিয়ে বললেন, একটা পানের প্রাণ থাকে কয়দিন হে?
আমি বললাম, তিন দিন?
নাহ্‌।
দুই দিন?
নাহ্‌।
এক দিন?
তা–ও না।
তাহলে?
১২ ঘণ্টা। হাফ দিন।

বিনয়ের সঙ্গে বললাম, স্যার, এখন তাহলে গিয়ে এক খিলি পান নিয়ে আসি?
পানের কথা শুনে মুখে কিছু বললেন না। তবে গেট থেকে সরে দাঁড়ালেন। আমিও সুন্দর করে বেরিয়ে এলাম।

ঘণ্টা দুয়েক পর বাইরে থেকে ঘুরেটুরে এলাম।
ঢোকার সময় হাসিমুখে হাতে পান ধরিয়ে দিলাম। চাচা গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠলেন, উঁহু, পান দিয়ে কেউ আমাকে ভোলাতে পারবে না। আমি মোকতার দারোয়ান। আমি এত সস্তা লোক না। যান, গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। অনেক ছাড় দিছি, আর না। আইন ভাঙা আমার দ্বারা সম্ভব না। যান, যান, গেটের বাইরে গিয়ে দাঁড়ান। আমি এখন কোনো কথাই শুনব না।

আমি তাঁর ব্যবহার দেখে রীতিমতো অবাক! কী আশ্চর্য, প্রিন্সিপাল স্যারও তো আমাদের সঙ্গে এ রকম রূঢ় আচরণ করেন না। দারোয়ান হয়ে এত সাহস কোত্থেকে পান, কে জানে।

দুই দিন আগের কথা। আমাদের এক স্যারের সঙ্গে আরও বাজে আচরণ করেছেন।
স্যার গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দারোয়ান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। স্যার হয়তো ভেবেছেন, দারোয়ান মানুষ উঠে পা উঁচু করে দুয়েকটা সালাম–কালাম দেবে। কিন্তু যা ঘটল, বিশ্বাস করার মতো নয়।

এই যে স্যার, শুনেন।
স্যার আঙুল নিজের দিকে নিয়ে বললেন, আমাকে ডেকেছেন?
আপনে ছাড়া আশপাশে আর কাউরে তো দেখতেছি না।
ওহ আচ্ছা। বলুন। কী বলবেন?
আপনের ঘড়িতে কয়টা বাজে?

স্যার ভেবেছেন মূর্খ-সুর্খ মানুষ, টাইম জানতে চেয়েছে, একটা বলে দিলেই হলো।
স্যার হাসিমুখে বললেন, নয়টা তেতাল্লিশ।
দারোয়ান শাহাদাত আঙুলের মাথায় চুন নিয়ে দাঁতে ঘষে বলল, কলেজে কয়টায় আসার কথা আপনের?
নয়টা দশে।
আপনে আইছেন কয়টায়?
তেতাল্লিশে।
কত মিনিট লেইট করেছেন?
৩০ মিনিট।
ঠিক কইরা কন, আমি যা যা জিগাইতাছি, সাফ সাফ উত্তর দেন।
স্যার আশপাশে তাকিয়ে হাসার অভিনয় করলেন, কেউ আছে কি না, ভালো করে দেখলেন।
দেখে বললেন, ৩৩ মিনিট।

শামসুল হক স্যার, দাঁত বের করে হাসবেন না কইলাম। আমি কোনো রম্য লেখক না যে আপনেরে আমি হাসির জোকস শুনাব আর আপনে খিলখিল করে হাসবেন। এভাবে দাঁত বের করে হাসা আমার একদমই পছন্দ না। আমাদের নবীজি কি কখনো দাঁত বের করে হেসেছেন, কন? হাসেন নাই। নবীজিই হাসেন নাই, আমরা উম্মত হয়ে দাঁত বের করে কীভাবে হাসি? একটু লজ্জা–শরম থাকা দরকার না আমাদের?

শিক্ষিত লোকের মুখে এত রংতামাশা আমার আবার পছন্দ না। শিক্ষিত লোক থাকবে গন্ডারের মতো ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে। তাদের গায়ে সুড়সুড়ি দিলেও হাসবে না। বর্তমানের শিক্ষিত লোকদের দেখেন, সারাক্ষণই হাসাহাসির মধ্যে থাকে। এত হাসি পায় কই, আমার তিন কেজি ওজনের মাথায় বিষয়টা বুঝে আসে না।

আজকে যান। কাল থেকে জাস্ট টাইমে কলেজে আসতে পারলে আসবেন, না আসতে পারলে দয়া করে বিদায় হবেন। দারোয়ানের কর্মকাণ্ড দেখে স্যার কিংকর্তব্যবিমূঢ়। রেগে আগুন হয়ে গেলেন ঠিকই, কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না। দারোয়ানের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলতে বলতে সোজা অফিসরুমে চলে গেলেন।

আমি বললাম, চাচা, গেটটা একটু খুলেন। জরুরি আলাপ আছে আপনার সঙ্গে।
না, আমার লগে কারও কোনো পিরিতির সম্পর্ক নাই। আমি এককথার মানুষ। গেট খোলা যাইব না তো যাইব না। ওপর থেকে কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে। আমি সব করতে পারি; কিন্তু আইন অমান্য করতে পারি না।

আমি মোতকার চাচাকে মিষ্টি করে একটু স্যার ডাকলাম। ডেকে বললাম, স্যার গো, ও স্যার, মুখটা একটু গেটের ফাঁক দিয়ে বের করেন। আপনার নূরানি মুখখানা একটাবার দেখি। ভেতরে ঢোকার আমার মনে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নাই। পড়ালেখা করে কী আর হব কন, শেষমেশ...

মোকতার চাচার মন গলে গেল। গেটের ছোট্ট গুলগুলি দিয়ে মুখটা হাঁ করলেন। আমি সুন্দর করে এক খিলি পান মুখে পুরে দিয়ে বললাম, দেখি, আরেকটু বড় করে হাঁ করেন। এই তো হয়ে গেছে। এখন মুখ মাইরে শক্ত করে একটা চাবান দেন।

আমি চাচার মুখে পান ভরে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সারা মুখে বিদ্যুতের মতো হাসি ফুটে উঠল। আহা, কী নির্মল হাসি। এই হাসি দেখলেই হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছা করে। পৃথিবীর সব নিয়মকানুন ভেঙে চাচার মতো এক খিলি পান খেতে ইচ্ছা করে!

**নাগরিক সংবাদে লেখা ও ছবি পাঠাতে পারেন [email protected]