পদ্মা সেতু শুধু দক্ষিণবঙ্গের নয়, পুরো দেশের
দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে পদ্মা সেতু অবশ্যই এক বিশাল মুক্তির সনদ। এক ইতিহাস। এক নতুন অধ্যায়। সেতু হয়েছে, এটা আমাদের জন্য আনন্দের। এতে কোনো ব্যত্যয় থাকবে না যে সেতুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিনম্র শ্রদ্ধা।
সমালোচনা করার অন্য অনেক জায়গা থাকতে পারে, সেগুলো নিয়ে হোক। সমালোচনায় সমস্যা নেই, কিন্তু আমাদের মতো যারা পদ্মার উত্তাল ঢেউয়ে বুকে পাথর চেপে কলিজা হাতে লঞ্চে কিংবা স্পিডবোটে পদ্মা পার হয়েছি, তারাই জানি, এই সেতু কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
সেতুর খরচ নিয়ে অনেকেই কথা বলেছেন। আদার ব্যাপারী, আসলে জাহাজের খবর নিয়ে লাভ নেই। আমি একটা মুখস্থ কথা বলে দিলাম আর হয়ে গেল না।
উদ্যাপন নিয়ে কথা! উদ্যাপন বেশি হয়েছে কি না, সেটা বলতে পারব না। কারণ, এর আগে তো এত বড় অর্জন আমরা পাইনি, তাই এটা বলা কঠিন। তবে সিলেটে বন্যা চলাকালে এ উৎসব ঠিক আছে কি না, সেটা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। আমার মনে হয়, বিষয়টা হয়তো আয়োজকেরা ভেবে দেখতে পারতেন। হয়তো উদ্যাপন কমিয়ে সেখানে সাহায্য করলে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ইতিহাস হয়ে থাকত। কিন্তু সেটা করেনি বলে বড় অপরাধ হয়েছে, তা–ও বলব না। কারণ, ত্রাণ আর সেতুর বাজেট আলাদা থাকার কথা। সেতু উদ্যাপন হোক, ত্রাণও বেশি করে দেওয়া হোক, তাহলেই তো হলো। আমাদের নিশ্চয়ই ত্রাণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অভাব থাকার কথা নয়।
এবার আসি সেতুতে কী কী করা যাবে বিষয়ে। আরে ভাই, এটা তো প্রমোদ উদ্যান নয়, একটা সেতু। অনেক সেতুতে পাশে জায়গা রাখা হয়। সেখান দিয়ে মানুষ হাঁটতে পারে, রিকশা, অটো অনেক কিছুই চলতে পারে। পদ্মা সেতুতে যেহেতু সেই অপশন নেই, তাই ওখানে গিয়ে বৃথা হাঙ্গামা না করাই শ্রেয় বলে মনে করি।
নাট খোলার বিষয়ে আসি। প্রথম কথাই হচ্ছে যে নাট খুলেছে, সে যেভাবেই খুলুক, ভুল সে করেছেই। এটা কোনোভাবেই মানানো যাবে না যে সে ঠিক করেছে। যদি সে প্রশাসনের লোক হতো সে সরাসরি অ্যাকশনে যেতে পারত। যদি সে সাংবাদিক হতো, তাহলে সে এটা নিয়ে প্রতিবেদন করতে পারত। কিন্তু সাধারণ নাগরিক হিসেবে সে ওটা খুলতে পারে না। তার উচিত ছিল কর্তৃপক্ষকে জানানো।
আর একটা বিষয় হচ্ছে, নাট কেন টাইট নয়! এটা নিয়ে আমরাও ধোঁয়াশার মধ্যে আছি। তিন ধরনের বক্তব্য পাচ্ছি—যদি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কারণে লুজ রাখা হয়ে থাকে, সেটা বলতে হবে; যদি কাজ বাকি আছে বলে রেখে দেওয়া হয়, তাহলে অবশ্যই কাজের দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের প্রশ্নের সম্মুখীন করতে হবে। এত বড় একটা কাজে এমন গাফিলতি সমীচীন নয়। অনেক আগেই তো ঘোষণা হয়েছে যে সেতু প্রস্তুত, তাহলে কেন এমন হলো?
আর তিন ধরনের বক্তব্য কেন আসবে? আমি নিশ্চয়ই ধরে নেব যে এত টাকা খরচ হয়েছে, সেখানে এই সামান্য কাজটা না করার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু যদি ইচ্ছাকৃতভাবে সেতুর কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এ কাজ করে থাকে, তাকেও খুঁজে বের করতে হবে।
টিকটক বা ভিডিও প্রসঙ্গে আসি। তারা আসলে সবকিছুর মধ্যেই কনটেন্ট খুঁজে পায়। মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা যা-ই হোক না কেন, তারা দেখে কনটেন্ট। আমার মনে হয়, এটা বন্ধ করতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। প্রশাসন চাইলেই এটা বন্ধ করতে পারবে। আর আমাদের নিজেদেরও বোধ বুদ্ধির বিষয় এটি। যেহেতু অনেক ভালো সড়ক, আর একপাশে গাড়ি চলবে, অপর পাশ দিয়ে গাড়ি আসার দুশ্চিন্তা নেই, তাহলে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ বিষয়ে সতর্ক নিজেদেরই হতে হবে।
মোটরসাইকেল বন্ধ প্রসঙ্গে। মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধের বিষয়টা আসলে মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে দেওয়ার মতো মনে হয়েছে। এখানে অবশ্যই মোটরসাইকেলের চালকদেরও দায় আছে। তারা তো মাথায় ক্যামেরা এঁটে বাইকের স্পিড মানুষকে দেখানোর জন্য উতলা হয়ে যায়। এটা তো কাম্য নয়। আর অনেকেই আসলে বাইক চালাতেও জানে না। কোনো প্রশিক্ষণ নেই, নেই লাইসেন্স পাওয়ার যথাযথ যোগ্যতা। কারও কাছে লাইসেন্স আছে মানেই যে সে বাইক চালাতে পারে, এটা বোঝার কোনো উপায় নেই। কারণ, আমরা ড্রাইভিং লাইসেন্স আর ফিটনেস সার্টিফিকেট পাওয়ার পদ্ধতিটা খুব ভালো করেই জানি। এটা পুরো জাতির জন্য একটা ব্যর্থতা। এভাবে প্রথম দিনেই দুজন মারা যাওয়ার ব্যাপারটা খুবই হতাশাজনক। এ সমস্যার সমাধান করাও কঠিন নয়। সেতুতে বিভিন্ন জায়গায় স্পিড ট্র্যাকার লাগিয়ে একটা নির্দিষ্ট গতিসীমা দিয়ে শাস্তির আওতায় আনা শুরু করলেই ঠিক হয়ে যাবে আশা করি। কিন্তু মোটরসাইকেল চলা বন্ধ করা সমাধান নয় বলেও মনে করি।
মোদ্দাকথা, সেতু সরকারের সম্পদ নয়, তা দেশের সম্পদ, জনগণের সম্পদ। একে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরই। পদ্মা সেতু শুধু দক্ষিণবঙ্গের নয়, হয়ে উঠুক সারা দেশের অর্থনীতির নতুন এক ভিত।