এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ

অ্যান্ড্রু কিশোরফাইল ছবি

গতকাল বুধবার (৬ জুলাই) স্বনামধন্য শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। আজ কিছু স্মৃতি খুব মনে পড়ছে। ছোট বেলায় রেডিওতে বাংলাদেশ বেতারের বিজ্ঞাপন তরঙ্গে সকালের অনুষ্ঠান ‘গীতালি’=কিংবা ‘অনুরোধের আসর গানের ডালি’ শুনতাম। গান শুনেই বলে দিতে পারতাম কোনটা তার কণ্ঠের গান। তার কণ্ঠে ছিল ভালোবাসার এক অনুভূতি, ছিল মধুর আওয়াজ। তার গান শুনে শুনে অলস দুপুর কেটে যেত আমার। এমনি করে তার গানগুলো আমাকে আলোড়িত করত। যদি এমন হতে পারতাম!

২০০১ সালে প্রথম ঢাকায় এলাম। ইচ্ছা ছিল শিল্পীদের দেখার। ২০০৮ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বাংলাদেশ- চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে দেখাও হয়েছিল তার সঙ্গে, তবে কথা হয়নি। ভারত থেকে এসেছিলেন ‘আই এম এ ডিস্কো ডান্সার’ গানের আরেক খ্যাতিমান শিল্পী বিজয় বেনেডিক্ত। আর সে দিন এন্ড্রু কিশোরও যুব দিবসে এসেছিলেন গান করতে। সেদিন তিনি গানে গানে যুব যুবতীদের মাতিয়ে তুলেছিলেন। আমারও সুযোগ হয়েছিল সেখানে যাওয়ার ও অংশগ্রহণ করার। যখন শুনলাম যে ২০২০ সালের ৬ জুলাই তিনি দীর্ঘ ১০ মাস মরণব্যাধী ক্যান্সারের সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করে না ফেরার দেশে চলে গেলেন, তখনই মনটা ভারী হয়ে উঠল। আজ বলতে ইচ্ছে করছে, ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।”

বাংলার কিংবদন্তী শিল্পী এন্ড্রু কিশোর যার সুরসুধা বাংলার মানুষকে করেছে বিমোহিত, আমোদিত, আনন্দিত, আলোড়িত, কখনোবা দুঃখিত, আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। যাকে ‘প্লেব্যাক সম্রাট’বলা হয়, তার প্রস্থান হল নীরবে নিভৃতে, অবেলায়-অসময়ে।

বরেণ্য শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের জন্ম পদ্মানদীর তীরে রাজশাহী শহরে ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর। বাবা ক্ষীতিশ চন্দ্র বাড়ৈ চিকিৎসাসেবার সাথে জড়িত থাকার কারণে তার পৈতৃক বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার কলাবাড়ি ইউনিয়েনের চিথলীয় গ্রাম ছেড়ে রাজশাহীতে আসেন। আর এখানেই স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন। এন্ড্রু কিশোরের জন্ম, শৈশব, কিশোর, যৌবন এবং পড়াশোনা এই শহরেরই। তার মা মিনু বাড়ৈ ছিলেন রাজশাহীর বুলনপুর মিশন গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষিক। মায়ের হাতেই শিক্ষার হাতে খড়ি। তার মা মিনু বাড়ৈ ভারতীয় শিল্পী কিশোর কুমারের অনুরাগী ছিলেন। তাই তার ছেলের নামও রেখেছিলেন কিশোর। বড় হয়ে এন্ড্রু কিশোর তার মায়ের সেই আশা পূর্ণ করেছিলেন।

একদিন চলচ্চিত্রের গানের রেকর্ডিংয়ে মনতাজুর রহমান আকবর, নজরুল ইসলাম বাবু,অ্যান্ড্রু কিশোর এবং শেখ সাদী খান
ফাইল ছবি

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি ছিলেন রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। তিনি নজরুল সংগীত, রবীন্দ্র সংগীত, দেশাত্ববোধক, লোক গানসহ প্রায় সব ধরণের গানই করতেন। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালীনই এন্ড্রু কিশোরের খ্যাতি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৭ সালে প্লেব্যাক গান করার জন্য ডাক পড়েছিল ‘মেইল ট্রেন’নামের একটি চলচ্চিত্রে “অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ” গানটি করার জন্য। গানের পাগল এ মানুষটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাসে রাজশাহী ছেড়ে ঢাকায় আসেন। তারপর গানই তার পেশা ও নেশা হয়ে উঠে। গানে গানে তিনি ব্যক্ত করেছেন জীবনের কথা, মানুষের কথা, দেশের কথা, বিরহ-আনন্দ-বেদনার কথা। তার জীবনে গানই ছিল তার প্রাণ। তাই তো তিনি গেয়েছেন, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান/সেদিন থেকে গানই জীবন, গানই আমার প্রাণ।’তিনি গেয়েছেন “গান আমি গেয়ে যাব এই আসরে/তোমাদের মন আমি নেবই কেড়ে/ক্ষতি নাই পড়ে থাকি যদি অনাদরে। আমার এ গান নাই হোক কারো সাথে তুল্য/আমার গানে নাই থাক এতটুকু মূল্য/ শুধু মনে রেখো, ভালবাসা দিয়ে রচনা করেছি তারে--- তবু দিয়ে যাব যত সুর আছে সবটুকু উজাড় করে।”

এন্ড্রু কিশোরের গান ছিল ভালবাসার গান। ভালোবাসার গান করতে গিয়ে গেয়েছেন, ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু ভালোবাসা পেলাম না/আশায় আশায় দিন যে গেল আশা পূরণ হল না।’সেই অতৃপ্ত ভালোবাসা বার বার ফিরে আসে তার এই গানে, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি/ আমার চোখ দু’টি মাটি খেয়ো না/আমি মরে গেলেও তারে দেখার সাধ/ মিটবে না গো, মিটবে না/তারে এক জনমে ভালবেসে ভরবে না মন, ভরবে না।’ কিবা ‘আমি চিরকাল প্রেমেরই কাঙ্গাল।’ জানি, তার সেই ইচ্ছা পূরণ হবে না। মাটি তার দেহ খাবে, তার চোখও খেয়ে ফেলবে কিন্তু তাকে আমাদের অন্তর থেকে মুছে ফেলতে পারবে না। তিনি আমাদের অন্তরে বেঁচে থাকবেন, সুরের জগতে বিচরণ করবেন। তার গানে ফুটে উঠেছে জীবনের বিরহ-কান্না, পাওয়া না পাওয়ার হাহাকার। তিনি গেয়েছেন, “জীবনের কাছে আমি দু’টি হাত বাড়িয়ে/ বুক ভরা ব্যথা শুধু পেয়েছি,/ নিয়তির কাছে আমি কি যে পাপ করেছি/দুঃখের আগুনে আমি জ¦লেছি,/না পাওয়ার হাহাকার কেঁদে যায় নীরবে/সময়ের কাছে হার মেনেছি/ভুল সবই ভুল, আমার সবই ভুল।’

বুলবুলের সুরে অনেক গান গেয়েছেন অ্যান্ড্রু কিশোর
ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

এই যাত্রাপথে তিনি জীবনের আনন্দ উপভোগ করেছেন, আর অন্যকেও জীবনকে নিয়ে উদযাপন করার ও উপভোগ করার আহ্বান জানিয়েছেন তার গানে। “জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প/যা কিছু দেখার, নাও দেখে নাও,/ যা কিছু বলার, যাও বলে যাও/ পাবে সময় আর হয়তো।” এ যেন তার নিজের জীবনের গান, নিজের কথাই ব্যক্ত হয়েছে এই গানে। তিনি অল্প বয়সেই মাত্র ৬৫ বছর বয়সেই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। যা কিছু বলার তিনি গানে গানেই বলে গেছেন। অবশেষে তিনি দয়াল যীশুর ডাকে সাড়া দিয়ে মৃত্যুনদী পাড়ি দিয়ে ওপারে চলে গেলেন। কারণ “ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে /রইব না আর বেশী দিন তোদের মাঝারে। আমি কত জনে কত কি দিলাম /যাইবার কালে একজনারো দেখা না পাইলাম/আমার সঙ্গের সাথী কেউ হল না রে।” হ্যাঁ আমরা আপনার সঙ্গের সাথী হতে পারলাম না, আপনার সঙ্গে অনেকেরই শেষ দেখাও হল না, শেষ বিদায় জানাতেও পারলাম না। আমাদের এই দীনতা, স্বার্থপরতা ওপর থেকে ক্ষমা করবেন।

শিল্পী এন্ড্রু কিশোর ছিলেন খ্রীষ্টান। খ্রীষ্টান হিসেবে তার পরিচয় দিতে কখনো কুণ্ঠাবোধ করেননি। তিনি গলায় ক্রুশ পরে অনেক গান করেছেন। খ্রীষ্টিয় সঙ্গীতেও তার অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৮৬ সালে যখন পোপ দ্বিতীয় জন পল বাংলাদেশে আসেন তখন তিনি গান করেছেন, ‘হেমন্তের স্নিগ্ধ শুভ্রপ্রাতে, রাঙা টোপর মাথে/তুমি এলে শিউলি ঝরা আমার আঙিনাতে।’ যীশুর যাতনাভোগ নিয়ে গান করেছেন, “ক্রুশবয়ে ত্রাণপতি যায় গিরিপথে/কাঁথে অঙ্গ থর থর পথ চলিতে (দয়াল)।” ক্রুশ নিয়ে গান করেছেন, “ক্রুশের চিহ্নে আমি হয়েছি চিহ্নিত/ যে ক্রুশেতে প্রভু যীশু হলেন সমর্পিত।” তিনি যীশুর মা মারীয়াকে নিয়ে গান করেছেন, “চিরদিন জানি আমি তুমি আমার মা জননী ক্রুশতলে/আমি তোমার দুষ্টু ছেলে কোল ছেড়ে যাই বন বাঁদাড়ে খেলার ছলে।’ বাংলাদেশের প্রথম বাঙালি আর্চবিশপ টি.এ গাঙ্গুলীকে নিয়ে গান করেছেন, ‘অমৃতের বরপুত্র তুমি, তুমি অমৃতময়/প্রণমি তোমারে বিনীত ভক্তজন, অন্তর উত্থিত অঞ্জলি/হে পুণ্য অমল গাঙ্গুলী।’ বড়দিন নিয়ে গান করেছেন, “বেথলেহেম গোয়াল ঘরে আর নয়, আর নয়/খ্রীষ্টজন আজ জন্ম নিতে ধরণীর প্রতিটি মানুষের অন্তরে।” এছাড়াও ‘প্রত্যাশা’ ক্যাসেটে “বরণডালার অর্ঘ্য”, ‘ঐশ নন্দন এলো এ ধরায়।’ ‘অনন্যা এ যামিনী’ক্যাসেটে “ভক্তিভাব বিমোহিতা” “অশান্ত এ পৃথিবীতে” দু’টি গান গেয়েছেন। “কাঁন্দি একা একা নদীর কূলে দেখি ঘাটে তরী নাই/আমার সঙ্গের সাথী ছিল যারা কেহ আমার সঙ্গে অসে নাই”, “আনন্দে দীন বন্ধু তোমার রাঙা পায়”।

এন্ড্রু কিশোর গেয়েছিলেন “আমি তো একদিন চলেই যাব, বেঁধে রাখা যাবে না/অনেক দূরে হারিয়ে যাব/কোথাও খুঁজে পাবে না।” সত্যি তাকে আর বেঁধে রাখা গেল না। তিনি অনেক দূরে চলে গেলেন। “প্রেমের সমাধি ভেঙে, মনের শিকল ছিঁড়ে পাখি যায় উড়ে যায়” গানের মত তিনিও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। ওপারে তিনি ভাল থাকুন সেই প্রার্থনা করি। আমরা “ভাল আছি, ভাল থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।”

লেখক: খ্রীষ্টান যাজক, পরিচালক, মরো সেমিনারী, ২৮ জিন্দাবাহার ১ম লেন, ঢাকা-১১০০।

**নাগরিক সংবাদে লেখা ও ছবি পাঠাতে পারেন [email protected]