সংস্কৃতির রাজনীতিকীকরণ ও বর্ষবরণ

ফাইল ছবি প্রথম আলো

বৈশাখ আয়োজনে আগেও আমরা ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি দেখেছি। সংস্কৃতির একপাক্ষিক ন্যারেটিভ শুনেছি। তবে বর্ষবরণের শোভাযাত্রা কি এবার চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক হয়ে উঠল? কথা উঠছে, একসময়ের মিলনের উৎসব এখন যেন পরিণত হচ্ছে মতাদর্শিক ময়দানে, যেখানে ‘শিল্প’ হয়ে উঠছে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবার শাণিত অস্ত্র, আর ‘উৎসব’ হয়ে উঠছে প্রোপাগান্ডার বাহন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে আয়োজিত এই বর্ষবরণ শোভাযাত্রা, যেটি আগে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে পরিচিত ছিল, ২০১৬ সাল থেকে ইউনেসকোর অপরিমেয় বিশ্ব সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃত; সেটি এবার নতুন নামে হাজির—‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।’ চারুকলার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে রাজনৈতিক শিক্ষকদের বলয়ে নিয়ে গিয়ে ওই নামবদলেই বিতর্কের সূত্রপাত। তারপর একে একে উন্মোচিত হয়েছে রাজনৈতিক ইঙ্গিতময় মোটিফ, মুখাবয়ব, ব্যঙ্গচিত্র এবং প্রতিহিংসার প্রতিচ্ছবি।

বিশেষত, শোভাযাত্রায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতীকী চিত্র হিসেবে যেই মোটিফ ব্যবহৃত হয়েছে, তা দেখে অনেকেই নানা কথা বলছেন। সেটির মুখাবয়ব নিয়ে নানাজন অভিযোগ করেছেন। এই অভিযোগ উড়িয়ে না দিয়ে বরং শিল্পের স্বাধীনতা ও ‘ফ্যাসিস্ট প্রতিচ্ছবি’র কথা বলে সেটিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে।

যাঁরা একসময় মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সরকারি প্রচারযন্ত্র বলে সমালোচনা করতেন, আজ তাঁরাই সেই একই মঞ্চে রাজনৈতিক বার্তা ঢুকিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের সুবিধার্থে। তখনকার শাসকদের প্রোপাগান্ডা যাঁদের চোখে লাগত, আজ তাঁরা নিজেরাই হয়ে উঠেছেন আরেক শাসকের ছায়া। মুখোশ পাল্টেছে, কিন্তু কৌশল তো একই রয়ে গেছে।

এই বর্ষবরণ শোভাযাত্রায় থাকা মোটিফের তালিকায় চোখ রাখলেই বোঝা যায় এর রাজনৈতিক বার্তা কতটা সুপরিকল্পিত ও সুস্পষ্ট। ৩৬ জুলাইয়ের টাইপোগ্রাফি, মুগ্ধ হত্যার প্রতীক, ফ্যাসিবাদী মুখাকৃতি—সব মিলিয়ে যেন এক রাজনৈতিক কোলাজ। এখানে নেই নির্ভেজাল লোকজ আনন্দ, নেই বৈচিত্র্যপ্রীতির নিরপেক্ষ চর্চা। আছে শুধু রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র আর সংস্কৃতির মোড়কে প্রতিপক্ষকে আঘাত করার নির্মম নকশা। বছরের প্রথম দিনে নির্মল আনন্দের সঙ্গে যার ভীষণ ফারাক।

রঙিন বর্ষবরণ আজ পরিণত হলো প্রতিশোধের ক্যানভাসে। চারুকলার মোটিফে এখন আর আনন্দ নয়, ফুটে উঠল প্রতিপক্ষকে অপমান করার সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ। এই ‘শিল্প’ আসলে পরিণত হয়েছে ‘রাজনৈতিক বিদ্বেষের চিত্রশালা’তে।

পয়লা বৈশাখের যে আবহমান চেতনা—ভিন্নমতের সহাবস্থান, মিলন আর সর্বজনীনতাকে ধারণ করা, তা আজ হুমকির মুখে পড়ল। যদি এই রাজনীতিকীকরণ চলতেই থাকে, তবে ভবিষ্যতে বর্ষবরণ আর ‘আনন্দ’ শোভাযাত্রা নয়, বরং হবে ‘বিতর্ক’ শোভাযাত্রা। আর তার সামনে থাকবে কোনো না কোনো মুখাবয়ব, যার পেছনে থাকবে রঙিন প্রতিশোধ আর শিল্পের নামে অজুত প্রোপাগান্ডা।

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]