তোফাজ্জল হোসেন: একজন বিরল ব্যক্তিত্বের কিছু কথা

তোফাজ্জল হোসেনছবি: সংগৃহীত

ভাষাসংগ্রামী ও কবি তোফাজ্জল হোসেন ছিলেন আমাদের দেশের পঞ্চাশের দশকের এক বিরল ব্যক্তিত্ব। মানুষটি ছিলেন চুপচাপ, মিতভাষী, কিন্তু নিজের সংকল্পে অটল। দেশভাগের পরবর্তী সময়ে কেটেছে তাঁর উত্তাল যৌবন, যখন ছিল ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, ছয় দফা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। নব্বইয়ের আন্দোলনে এরশাদের পতনের সময়ও তিনি ছিলেন সোচ্চার।

কবি ও কবিতাপ্রেমিক মানুষটি দেশের প্রয়োজনে নিজের কবিসত্তাকে অনেকটা বিসর্জন দিয়ে হাতে তুলে নিয়েছিলেন সচেতন সমাজ তৈরির জন্য কলম। সমাজ, দেশের মানুষ ও তরুণ–যুবসমাজকে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে এক হাতে লিখে চলেছিলেন কবিতা, আরেক হাতে বিশ্ব ও বাংলাদেশের জন্য সুন্দর ও ঝুঁকিমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে চালিত করেছিলেন তাঁর লেখনী। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলির দিকে তাকালেই সেটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়।

তোফাজ্জল হোসেন লিখেছেন বিশ্ব ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে ‘শিশু’, তাদের দারিদ্র্য, শিক্ষা, মৌলিক চাহিদা ও উন্নয়নের কথা; তিনি লিখেছেন আগামী পৃথিবীর জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ও বিপন্ন জনপদের কথা, তিনি লিখেছেন জাতিসংঘের মতো বিশাল এক হিমালয়ের কথা। ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রতি তাঁর ছিল আজীবন জিহাদ। ধর্মকে তিনি নিজের অন্তরে গ্রহণ করেছিলেন। পোশাকি ধর্মে তাঁর বিশ্বাস ছিল না।

যখন দেশের মানুষ সচেতন ছিল না, তখন থেকেই তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলে আসছিলেন। এর ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করেছিলেন।

তোফাজ্জল হোসেন লিখেছেন আমাদের ভাষাসংগ্রামের কথা, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা, তিনি লিখেছেন একুশের কবিতা ও গান, এক ও একাধিক। সেসব গান তখন গাওয়া হয়েছিল পল্টন ময়দানে, হাজার হাজার জনতার সম্মুখে, উদ্বেলিত করেছিল তরুণসমাজকে।

কবি তোফাজ্জল হোসেন তাঁর দীর্ঘ জীবনের প্রতিটি অধ্যায়কে কাজে লাগিয়েছিলেন দেশ গড়ার কাজে।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সরকারি একজন বিশিষ্ট কর্মকর্তা হওয়ার পরও দেশের এমন কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না, যেমন ক্রীড়া, সংস্কৃতি, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, যেখানে তাঁর বলিষ্ঠ পদচারণ ঘটেনি। দেশের জন্য, দেশের শিল্পসংস্কৃতির অগ্রগতির জন্য, দেশের যুবসমাজকে পৃথিবীর পথে অগ্রসর করে দেওয়ার জন্য তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টার কথা কারও অজানা ছিল না। তিনি অল্প কথার মানুষ ছিলেন, কিন্তু দেশের এমন কোনো সংগঠন ছিল না, যার সঙ্গে তিনি আমরণ সম্পৃক্ত ছিলেন না। তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন বুলবুল ললিতকলা একাডেমির সঙ্গে। তিনি মুকুল ফৌজ, শিশু কল্যাণ পরিষদ, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব, বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি, সাংবাদিক ইউনিয়ন, জাতীয় প্রেসক্লাব প্রভৃতি সংগঠনের কার্যক্রমের সঙ্গে ছিলেন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাঁর জীবনে নিজস্ব ও ব্যক্তিগত সময় বলে কিছু যেন ছিল না। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশটির কল্যাণ সাধনায় তিনি তাঁর স্বকীয়তাকে যেন দেশমাতৃকার পাদপীঠে বিসর্জন দিয়েছিলেন। সেই স্বকীয়তা ছিল তাঁর কবিসত্তা। তিনি ছিলেন মূলতই একজন কবি, যেমন কবি ছিলেন শামসুর রাহমান। ১৯৫৩ সালে, ভাষা আন্দোলনের মাত্র এক বছর পরেই কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত অমর ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনে ঐতিহাসিক যে দুটি গান সংকলিত হয়েছিল, তার একটির রচয়িতা ছিলেন তিনি। তখন দুটি গানেরই সুরারোপ করা হয়েছিল।
কবিতার জগতেও তোফাজ্জল হোসেন ছিলেন অনন্য শব্দাবলির অধিকারী। সত্যকে অকপটে উচ্চারণ করার সাহসী কারবারি। প্রেম, বাসনা ও একুশের চেতনায় তাঁর কবিতাবলি ভরপুর।

এখানে তোফাজ্জল হোসেনের একটি কবিতার কয়েকটি ছত্র তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না—
‘পথের শুরুতে দেখা অন্যপ্রান্তে অযাচিতে হয়ে গেল শেষ
এরই মাঝে পরিচয়, ভালো লাগা, ভালোবাসা, প্রগাঢ় আবেশ,
সূর্যোদয়ের সাথে তাৎক্ষণিক সূর্যাস্ত বিশ্বপটে কভুও কি হয়?
উদয়ের সাথে তার অবস্থান, আরো কিছু আলোময় রয় অবশেষ,
তেমনটি হয়ে গেল কী যে এক আচমকা দৈব-দুর্বিপাকে
সেই থেকে আজো আমি ওর কথা মনে করি স্মরণের ফাঁকে।’
মথিত-মানস।

তোফাজ্জল হোসেন যে শুধু নিজে কবি ছিলেন, তা–ই নয়, বিশ্বের অন্য কবিদের কথাও তাঁর কাছে আমরা শুনতে পাই। তিনি রুশ কবিদের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। বেশ কিছু প্রগতিশীল উর্দু কবিতাও অনুবাদ করেছিলেন।

রুশ কবি কাইমিন কলিয়েভের ‘মায়ের হৃদয়ে’ কবিতাটির অনুবাদ এ রকম—
‘...কোনো যুদ্ধে যত বুলেট নিক্ষেপিত হয়, এর প্রতিটিই
স্থান করে নেয় কোনো-না-কোনো মায়ের হৃদয়ে
যে বা যারাই হোক যে-কোনো যুদ্ধে বিজয়ী বা বিজিত
যুদ্ধ হলেই মায়ের বুক বিদীর্ণ হওয়া একান্ত অবধারিত।’

শুধু রুশ নয়, উর্দু কবিতার অনুবাদেও তিনি কতটা যে সচ্ছল, তা এ কবিতার অনুবাদ পড়লেই বোঝা যায়। যেমন কবি হাবিব জালিবের কবিতা—
‘আমিও যদি সাম্রাজ্যবাদীদের একজন পদলেহী হতাম
আমার জীবন হতো একটি কেকের টুকরো
আমার সন্তানরাও পড়াশোনা করত আমেরিকায়
এবং আমি প্রতিটি গ্রীষ্ম কাটাতাম ইংল্যান্ডে
আমার ইংরেজি হতো কোমল মসৃণ
আমি যদি নিছক একজন উর্দুওয়ালা না হতাম
আমি যদি “নাইট” খেতাবির জন্য
আমার মস্তক করতাম অবনত
আমি হয়ে যেতাম একজন স্বনামধন্য নেতা
আমার বিষয়-সম্পত্তি থাকত প্রতিটি অঞ্চলে পরিব্যাপ্ত
হলফ করে বলছি: আমি আমার দেশের
এমনকি রাষ্ট্রপতি বনে যেতাম।’

এত সব কথা বলার পরও আরও কিছু কথা বলার থাকে। কিছু ব্যক্তিগত কথা। আর সেটি হলো সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে কবি তোফাজ্জল হোসেনের আমরণ বন্ধুত্বের কথা। ছাত্রজীবনে তাঁরা দুজন ছিলেন সতীর্থ। দুজনেরই জন্ম একই সালে এবং মৃত্যুও প্রায় একই সময়ে। মাত্র দু–এক মাসের হেরফের। তাঁরা ছিলেন পঞ্চাশের দশকের রেনেসাঁ সন্তান। সৈয়দ হকের মুখে যখনই আমি কবি তারিক সুজাতের কথা শুনতাম, সেই সঙ্গে আমি শুনতাম কবি তোফাজ্জল হোসেনের কথাও। তাঁদের দুজনের ছেলেবেলার কথা স্কুলও কলেজজীবনকে নিয়ে। তাঁদের দুজনকে নিয়ে একটি গল্পের কথাও সৈয়দ হক আমাকে প্রায় বলতেন।
গল্পটা ছিল এ রকম—

১৯৫৩ সালে কবি হাসান হাফিজুর রহমান ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ নিয়ে সংকলনটা ছাপা হয়ে বেরোনোর পর পাকিস্তান সরকারের হুমকিতে যখন তরুণ লেখকেরা আন্ডারগ্রাউন্ডে আশ্রয় নিলেন, তখন সেই লেখকদের ভেতরে ছিলেন তোফাজ্জল হোসেন ও সৈয়দ শামসুল হকও। তাঁরা সবাই মোটামুটি গা ঢাকা দিলেন। তখন একদিন তোফাজ্জল হোসেন একটি দোকানের পেছনে দাঁড়িয়ে একজন লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন, সেই সময় সৈয়দ হক সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। সেই ভদ্রলোক জানতেন যে মোফাজ্জল গা ঢাকা দিয়ে আছেন, সৈয়দ হককে দেখে যখন মোফাজ্জল এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে লাগলেন, তখন সেই ভদ্রলোক বারবার করে তাঁকে বাধা দিতে লাগলেন অন্তরঙ্গ কথা অচেনা মানুষের সঙ্গে না বলতে! তিনি সৈয়দ হককে লেখক হিসেবে চিনতেন না।

তোফাজ্জল বারবার করে লোকটিকে বলতে লাগলেন, আরে, এ আমাদের লোক।

তবু ভদ্রলোক বললেন, হোক, তবু এর সামনে গোপন কথা না বলাই ভালো।

তোফাজ্জল তাঁর কথা আমলে না নিয়ে আবার যখন কথা বলতে লাগলেন সৈয়দ হকের সঙ্গে এবং আবারও সেই ভদ্রলোক (তিনিও নিশ্চয় কোনো তরুণ হবেন) তাঁকে বাধা দিতে লাগলেন, তখন কথা নেই, বার্তা নেই, মোফাজ্জল সোজা সেই ভদ্রলোকের নাকে এক ঘুষি মেরে বসলেন। বললেন, আরে, তোমারে বারবার বলছি না যে এ আমাদের লোক?

এখন ভাবলে অবাক হতে হয় এই কথা ভেবে যে তাঁরা সবাই ছিলেন মাত্রই কৈশোর পেরোনো তরুণ।
কারও বয়সই তখন আঠারো বা বিশের ওপরে নয়। অথচ প্রগতিশীলতার ইতিহাস গড়ার পেছনে তাঁদের কারও ভূমিকাই এখন আর খাটো করে দেখার উপায় নেই।

সৈয়দ হক গল্পচ্ছলে অনেক সময় বলতেন, মোফাজ্জলকে বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না, একেবারে ব্রিটিশ আমলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মতো স্থির ও গম্ভীর, কিন্তু ওঁর ভেতরটা আবেগে টইটম্বুর। শুধু তা–ই নয়, একেবারে বন্ধুগতপ্রাণ।

এমনও আমি শুনেছিলাম যে সৈয়দ হক, তোফাজ্জল হোসেন ও পটুয়া কামরুল হাসনের ছোট ভাই, তাঁরা তিনজন একসঙ্গে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে আড্ডায় বসতেন, তখন সেই আসরে একজন একটি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করার পরপরই অন্যজনকে তার রেশ ধরে অন্য আরেকটি সমমানের কবিতা আবৃত্তি করতে হতো। এটি ছিল একধরনের বুদ্ধির চর্চার প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতা ছিল দেখার মতো। একের পর এক কবিতা আবৃত্তি করতেন তাঁরা তিনজনে বসে। কেউ কাউকে হারাতে পারবে বলে মনে তখন মনে হতো না। এমনকি এ নিয়ে প্রতিযোগিতাও হতো এবং পুরস্কার দেওয়াও হতো। সেসব ছিল এক সোনালি অধ্যায়ের যুগ, যা এখন আর কল্পনাও করা যায় না।

আমি মোফাজ্জল সাহেবকে দেখেছিলাম সাভারের একটি হাউজিং কমপ্লেক্সে। তিনি সমিতির মিটিংয়ে চুপচাপ বসে থাকতেন। খুব কম কথা বলতেন। কখনো–বা বলতেনই না। কিন্তু যখনই কথা বলতেন, সবাই মন দিয়ে শুনত এবং তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করত। আমি সেখানে দূর থেকে তাঁকে দেখতাম। তাঁকে সমীহ করতাম। তারিক সুজাতের পিতা বলেই আমি তখন তাঁকে জানতাম। সৈয়দ হকের এ রকম এক ছেলেবেলার বন্ধু বলে জানতাম না। তিনি হয়তো আমাকে চিনেছিলেন, কিন্তু কখনো নিজের পরিচয় সেভাবে দেননি। তাঁর মৃত্যুতে সৈয়দ হক শোকাহত হয়েছিলেন। সেদিন শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে সতীর্থের স্মৃতিদেহের সম্মুখে দাঁড়িয়ে সৈয়দ হক বলেছিলেন কিছু কথা, সেই কথাগুলো এখানে উল্লেখ না করে পারছি নে।

সৈয়দ হক বলেছিলেন, ‘আমরা তাঁকে ভাষাসৈনিক বললেও সে ছিল এ দেশের স্বাধিকার, স্বাধীনতার পক্ষের এক মহান চিন্তক। নীরবে নিভৃতে তিনি কাজ করেছেন। প্রথমেই সম্মুখে আসেননি; বিজ্ঞাপনে নিজেকে তুলে ধরেননি। সব সময় তাঁর ভেতরে লক্ষ করেছি এক নিবিড় নিবিষ্ট মননশীল মানুষকে, যিনি এখন আমাদের ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন। এ ইতিহাস আমরা যেন কখনো ভুলে না যাই।’
এই কথাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলতে চাই বা ধারণা করি, একমাত্র এক বিশুদ্ধ কবির পক্ষেই ‘এক নিবিড় নিবিষ্ট মননশীল মানুষ’ হয়ে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকা সম্ভব। তা না হলে এই সংঘাতসংকুল বাসভূমিতে তিনি এতটা বছর বেঁচে থাকতে পারতেন না। কবিতার প্রেরণাই মানুষকে বেঁচে থাকার সাহস জোগায় এবং এখন আর আমাদের সন্দেহ নেই যে বাংলার অমর সন্তানদের আসরে তিনি নিজের স্থান করে নিয়েছেন।

লেখক: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক