দুই চোখ খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি

‘নাগরিক সংবাদ’–এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]

এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায়ী অনুষ্ঠানছবি: লেখকের পাঠানো

আজি পরীক্ষা জাগ্রত দ্বারে, এমনই অবস্থায় এসএসসি পরীক্ষার্থীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিদায় নয়, এ যেন শুধুই সংবর্ধনা। পেছনে রেখে যাওয়া স্নেহসিক্ত কনিষ্ঠরা আবেগে আপ্লুত হলো। তারা ‘তবু যেতে দিতে হয়’ বলে মেনে নেয় বাস্তবতাকে। বিদায়ী যারা, তাদেরও ভাবগম্ভীর মুখাবয়ব।

অনুষ্ঠান আয়োজনে ফরিদপুরের নগরকান্দার চাঁদহাট বাজার উচ্চবিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাদের আশীর্বাদ করা হলো। একই অনুষ্ঠানে তাদেরই হাতে ‘শুভকামনা স্মারক’ তুলে দিলেন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হারেজ মোল্যার পরিবারের সদস্যরা।

প্যান্ডেলটি জ্বলজ্বল করছিল। অনুষ্ঠান আয়োজনে সভাপতি সিরাজ ফকির স্বপ্ন দেখেন। দূরে এ পি জে আবদুল কালাম। বাবা নৌকা চালিয়ে সংসার চালাতেন। ওই সময় তিনি তাঁর জন্মদাতাকে কাজে সাহায্য করতেন। সেই তিনি এখানে সাধারণ ছাত্র। তবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়তেন। সিরাজ বললেন, ‘বিজ্ঞানে অবদানে তুমিই হবে আমাদের কালাম।’

কৃষ্ণপদ বসুর অনন্য আবিষ্কার। ডা. জোহরা বেগম কাজী সামনে। বলেন, দাঁড়াও! অজ্ঞতা আর কুসংস্কার দূর করতে অসীম তাঁর চেষ্টা। তিনি মনে করেন, এই দায়িত্ব আজ তাঁরই প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীর। সাজেদুর রহমান মুরাদ এই বিষয়টিতে আরও জোর দেন। ঢাকার ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল–খ্যাত এই নারী। বায়ান্নতে–একাত্তরে অনবদ্য অবদান রেখেছেন। মুরাদ আশা প্রকাশ করেন, এই জোহরাই সেই নাইটিঙ্গেল হয়ে উঠবে।

আজিজ তালুকদার বসে। পাশ দিয়ে হেঁটে যায় নূরলদীন। চোখ এড়ায় না। স্কুলের আরও অগ্রগতি চাই। একদিন শুনেছিলাম, নূরলদীন একবার আসিবে বাংলায় আবার নূরলদীন একদিন কালপূর্ণিমায় দেবে ডাক, জাগো বাহে কোনঠে সবায়। আশায় বুক বাঁধেন আজিজ। তিনি বলেন, স্কুলের মর্যাদা তুলে ধরতে হবে অগ্রজের মতোই।

মোহাম্মদ আলী বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই স্কুল চলবে এর নিজস্ব গতিতে। গুণীরা কেবল হালটা ধরে রাখবেন। হাফিজুর রহমান মুন্সি শিক্ষার ক্ষেত্রটি আলাদা রাখতে চান। এ–ও এক যুদ্ধ। হেলাল হাফিজের কথায়, ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ সবাই দেখেন, সব হাত এক হয়ে যায়। সালাউদ্দিন শাহীন কিন্তু একই ধারণা পোষণ করেন। বলেন, এখানে বিভিন্ন ধারার মানুষ আসবে। তবে মত বিনিময়ের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে।

শুভকামনা স্মারক দেওয়া হচ্ছে পরীক্ষার্থীদের হাতে
ছবি: লেখকের পাঠানো

অনুষ্ঠান চলছিল। সঞ্চালনা করছেন কামরুজ্জামান। ফাঁকে ‘নিরন্তর শুভকামনা’ পড়লেন অনন্য বিশ্বাস। বাউষখালি স্কুলের পক্ষ থেকে পরীক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানালেন অলক সরকার।

জ্যেষ্ঠদের স্নেহধন্য হয়েছে এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা। সুরাইয়া আক্তার গভীরভাবে ভেবেছে বিষয়টি। সে বলল, দেখা কিংবা কথা না হলেও হৃদয়ে রয়ে যাবে একরাশ ভালোবাসা। ‘প্রাণের ভাষ্য’ পড়ল নিজের লেখা থেকে। অন্যদিকে খুশি আক্তার ও মার্জিয়া আক্তার পড়ল, ‘প্রিয় কথন’। একজন বলে তার সহপাঠীদের নিয়ে। একঝাঁক নক্ষত্রের আবির্ভাব হয়েছিল সেদিন। এরপর কোনো এক চৌরাস্তার মোড়ে দেখা হবে। হয়তো ছেড়ে দিতে হবে তখনই। সে কথা ভাবতে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। আরেকজন পড়ে, শৈল্পিক শিক্ষা পেয়েছে তারা এই স্কুল থেকে। মুগ্ধতা তার চোখেমুখে।

কুসুমকুমারী দাশ খুঁজছিলেন নতুন মুখ। ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে।’ কামাল মাতুব্বর বলেন, ‘সেই তারাই তোমরা। পরিশ্রমই সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। কাজেই তোমরা বাঁধবে না।’ মতিয়ার রহমান পরীক্ষার্থীদের ওপর ভরসা রাখেন। বললেন, ‘তোমরা পারবে এবং তোমাদের কাজে–কর্মে সেই লক্ষণ স্পষ্ট।’

গোলাম মোস্তফা ফুল আর ভালোবাসার স্মারক গোছগাছ করার কাজে ব্যস্ত। একটু দূরেই বেগম রোকেয়া। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ তাঁর হাতে। মূল বার্তা, নারীর প্রতি অবিচার রোধ করতে হবে। মোস্তফা বলেন, সে জন্যই শিক্ষা নিতে হবে গভীর মনোযোগে। শিক্ষা আর পছন্দসই পেশা ছাড়া নারীমুক্তি আসবে না। আশাপূর্ণা তারা। কাজেই তাদের রুখবে কে?

ওরা পরীক্ষার্থী আজি পরীক্ষা জাগ্রত দ্বারে
ছবি: লেখকের পাঠানো

ফোনে যুক্ত হন হাফিজুর রহমান। দূর থেকেই হীরক খনির সন্ধান দিচ্ছেন। ওই যে ওখানে জগদীশচন্দ্র বসু। উপমহাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া বিজ্ঞানী। ‘বসু মানমন্দির তার জন্য খোলা।’ এদিক থেকেই জানানো হয়। ইব্রাহিম মুন্সি তাদের তাগিদ দেন। বলেন, লেখাপড়ায় ভালো করে ওই জায়গা বুঝে নিতে হবে।

নিমাই সরকার চলছেন...। আবিষ্কার করেন এক প্রতিভা। এই তো সেই প্রাণময় কন্যা! ‘বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি।’ জীবনানন্দ পেয়েছেন তাঁকে একদিন। বলেছেন, ‘আজ তোমার কর্মে অভিষেক। একইভাবে ঝরনা ধারার শব্দ বেজে ওঠে পথিকের কণ্ঠে। ‘মোমবাতির সলতের মতো পুড়তে হবে তোমাকে। আলোকিত করতে হবে চরাচর।’

এবার শেষের পালা। চাঁদহাট হাইস্কুল আর সাবেক চেয়ারম্যান হারেজ মোল্যার পরিবারের পক্ষ থেকে পরীক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ভালোবাসার অর্ঘ্য। বলা হয়, ‘তোমাদের এ জয়যাত্রায় পাশে আছি আমরা। আছে এই দেশ, এই মাটি, এই মানুষ।’

তোমাদের জয় অনিবার্য।

*লেখক: নিমাই সরকার: প্রকৌশলী