গোপালগঞ্জের ছোট বাহাড়ায় নাম সংকীর্তন

ছবি: লেখকের পাঠানো

নেত্রকোনার কুলেশ্বরী সম্প্রদায় তখন আসরে। এমন আরও পাঁচটি দল পালাক্রমে নাম কীর্তন করে যাচ্ছে। বৃষ্টি ভেজা দিনে তাদের সেরাটি দিতে কার্পণ্য করছে না। ভরসা আঙিনা ঢাকা সায়মানা। আর চারদিকে ঘেরা ঘরের মুক্ত বারান্দা। আমরা অনুষ্ঠান উপভোগ করছি।

মৃদঙ্গ বাজে একজোড়া। মধুর বাঁশরীর সুর আকর্ষণ করে ভক্তের মন। ধীর লয়ে চলছে সবকিছু । এরপর উজ্জীবিত হন শীর্ষস্থানীয় একজন। তিন আঙুলে ব্যাখ্যা করেন নিধুবনের বৈচিত্র্য। আধ্যাত্মিক সুষমা আনে চরাচরে।

মন্টু সরকার নিজেকে অর্পণ করেন দেবতার পাদপদ্মে। হরে কৃষ্ণ বলে জোরে টান দেন দলের অগ্রণী। সুর তাল লয়ে বেঁধে ফেলেন গোটা পরিবেশ।

এবার মৃদঙ্গ কথা কয়। সে তার নিজস্ব ভাষা। নাকি কালিপদ শীলের কথনের মতোই! ‘খোলে কয় কৃষ্ণ কথা’। কালু শীলের জন্ম অদূরে আমারই চাঁদহাট গ্রামে। ছোটবেলার কথা চলে আসে। তাঁকে কীর্তন জগতে মৃদঙ্গ বাদনে সেরাদের একজন মনে করা হতো।

সেতার টুনটুন করে এগিয়ে নেয় প্রহরকে। সুরের মূর্ছনায় অন্যরকম এক দ্যোতনা আনে। সামনে আসেন বাদক। যেমন করে অন্যরা যান পেছনে। ভক্তরা গভীর মনোযোগে দেখছেন শৃঙ্খলার খেলা।

গোপালগঞ্জের ছোট বাহাড়া গ্রাম। উদ্যোগটি নিয়েছে এখানকার নামযজ্ঞ সেবা সংঘ। চিঠিতে শ্রীকৃষ্ণের মুখনিসৃত বাণীর উল্লেখ আছে। আমার চেয়ে আমার নাম বড় আর নামের চেয়ে ভক্ত। লক্ষণ বৈরাগীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের এ যজ্ঞানুষ্ঠান। আমি না শ্রোতা, না ভক্ত। অথচ আমন্ত্রণ কালে আয়োজনের মুখপাত্র অরবিন্দ রায় নিশ্চিত না করে ছাড়েন না। আমাকে আসতেই হবে। আব্দুল খালেক একাডেমির এ শিক্ষক তাঁদের প্রস্তুতির খুঁটিনাটি তুলে ধরলেন। 'না' বলার সুযোগ পাইনি।

গতকাল ছিল কথা-কীর্তন। কথাকে কীভাবে শিল্পের পর্যায়ে নেওয়া যায়, না দেখলে বুঝা যায় না। এমনই বলছিলেন একজন। ওই পর্বে কথক ছিলেন রণজিৎ গোস্বামী । কথা ছিল, আমারই প্রিয় সুশীল কুন্ডু স্যারেরও কথা শুনব ঐদিন। সেটা সম্ভব হয়নি। আমাদের মধ্যে আলোচনায় ছিলেন অপূর্ব আনন্দ রায়। নাম সুরের পাশাপাশি মৃদু লয়ে আমাদেরও কথা চলে।

টিপ্ টিপ্ করে বৃষ্টি পড়ে। কখন বা একটু ভারী হয়ে ওঠে। আমরা বারান্দায় আঁটসাঁট হয়ে বসে নিই। সুযোগে পরিচয় নিলাম। একাউন্টিং থেকে অনার্স করেছেন তরুণ। এখন মাস্টার্স শুরুর পালা। চমৎকার একটি যাত্রা , অপূর্ব'র লেখা পড়ায় মন্তব্য আমার।

শ্রোতাদের গভীর মনোযোগ কীর্তনে। ষোলো নাম বত্রিশ অক্ষর। এই নিয়ে চর্চা। সনাতনীদের কাছে মন্ত্রটি পবিত্র। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই মন্ত্রের মাধ্যমে তাঁরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন। এই নামেই তাঁর প্রতি প্রেম ও ভক্তির প্রকাশ। এই মন্ত্র জপ করলে মানসিক শান্তি পাওয়া যায়। জীবনের বিভিন্ন সমস্যাও উৎরে যাওয়া যায়।

কৃষ্ণ নামের মাহাত্ম্য কি? কি আছে এই কৃষ্ণ নামে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন ভক্তরা। একবার দেবর্ষি নারদ স্বয়ং ভগবানের কাছে গেলেন। ভগবান বললেন , কৃষ্ণ নামের মাহাত্ম্য জানতে হলে যমরাজের কাছে যেতে হবে। তাই নারদ গেলেন যমালয়ে। তিনি প্রশ্নের উত্তর পেলেন না। এ সময় তাঁর কানে এলো ক্রন্দনের রোল।

নরকে পাপীদের ভয়ঙ্কর কষ্ট দেখে নারদ হা কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ বলে ধ্বনি দিতে লাগলেন। দেখলেন এই ধ্বনি পাপীদের কর্ণে প্রবেশ করছে আর তারা মুক্ত হয়ে স্বর্গ ধামে চলে যাচ্ছে। এই হলো কৃষ্ণ নামের মহিমা। এই নামেই কলির মুক্তি। হরে কৃষ্ণ... ... হরে হরে।

নাম তাঁর তিথি বিশ্বাস। নওয়াপাড়া মডেল কলেজ উৎরানো সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে বিয়ে। জন্মস্থান অভয়নগর। আগ্রহ আমার ঐখানে। রাজনৈতিক কোনো পরিবর্তন এলেই হাঙ্গামার শিকার হয় গ্রামটি। কেন? তরুণী দ্বিধা না করেই বলেছেন, কারণ ওই 'জমি জমা' । তবে এও বলেছেন, ধ্বংসাত্মক কাজগুলো করে দূরের মানুষ। আমি তুলনা করি এই গ্রামের সাথে। এখানে নিরন্তর 'অভয় বাজে হৃদয় মাঝে'। তা না হলে এমন আয়োজন কীভাবে সম্ভব?

জগাই মাধাই উদ্ধার পর্বের মঞ্চায়ন হয়। আয়োজনের শেষের দিনের কথা বলছি। এই কলি যুগে ষোড়শ শতাব্দীর নবদ্বীপের ঘটনা।

হরিদাসকে সঙ্গে নিয়ে নিত্যানন্দ চলেছেন সংকীর্তনে। এ সময় জগাই মাধাই তাঁদের ওপর তেড়ে এলো। এক পর্যায়ে কলসির কানা দিয়ে তাঁকে আঘাত করলো। দরদর করে রক্ত পড়ছিলো তখন। গৌরাঙ্গ ছুটে এলেন। বজ্রকণ্ঠে সুদর্শন বলে হুঙ্কার দিলেন। আর যায় কোথায় ! অগ্নিগোলকের মতো সুদর্শন চক্র দৃশ্যমান হলো।

এমন এক কঠিন অবস্থা তখন। নিত্যানন্দ প্রতিশোধ নিবেন কি, মাতালদের রক্ষা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এসময় তিনি গৌরাঙ্গের সাহায্য প্রার্থনা করেন। আঘাতপ্রাপ্ত নিতাইয়ের মহানুভবতায় মুগ্ধ হয় তারা। মুখে তুলে নেয় হরিনাম।

অভিনয়ে প্রশংসা অর্জন করেন কুশি লবেরা। রূপায়ণে : শ্রীকৃষ্ণ - অপূর্ব আনন্দ রায় , রাধা রাণী -রিতু রায় , গৌরাঙ্গ -পবিত্র রায় ,নিতাই - কৃপাসিন্ধু রায় , জগাই -বলরাম রায় ,মাধাই - জয় বিশ্বাস , বৈষ্ণব - নিত্যানন্দ রায় ,বৈষ্ণবী - বর্ষা বিশ্বাস।

খমক বাজে আপন তালে। যন্ত্রের পেটের ভেতর থেকে বের করা হয় দুটো তার। কর্ডের কারুকার্যে খম খম খমক সুর ওঠে। দীপঙ্কর মাঝি যন্ত্রটির বাজিয়ে । বলরাম রায় বলে দেন নামটি । আসরে নাম কীর্তন চলছে। পেছনে সুর , তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো ... .....।

নতুন জোয়ার এলো। ভেবেছিলাম তাই। না, ক্রন্দনের সুর। যেন দূর থেকে ভেসে আসে। তাও না। ভেতর থেকেই আসছে এ সুর। দীর্ঘ টা--ন। বোলো হরিবোল, কৃষ্ণ নামে অংশ নিতে আহ্বান। অকস্মাৎ পরিবর্তন। বিগলিত মন। দেখি জোড়ায় জোড়ায় আলিঙ্গন। একজন আরেক জনের মধ্যে দেবত্ব খুঁজে পান ।

হরিবোল হরিবোল ধ্বনিত হয় উচ্চকন্ঠে। সাথে উলুধ্বনি। ধন্য ধন্য বলি তারে ...। আটাডাঙা বাওড়ের পারে উঠে আসে বৃন্দাবন। ছোটবাহাড়া সে পল্লীর নাম।

লিপি বিশ্বাস। খালেক একাডেমির আর এক শিক্ষক। আপ্যায়িত হই তাঁরই তত্বাবধানে , তাঁরই এই শ্বশুর বাড়িতে। চাঞ্চল্য দেখি তার দুই কন্যা অর্পিতা আর অন্বেষার। তারপর ফেরা। ভ্যানের পথ।...চলছি আমরা।

কানে কিংবা মনে বাজে লালন শাহ। ধন্য ধন্য বলি তারে ... ... ।