ওপেনহাইমার কি শুধুই একটি চরিত্র

ছবি: সংগৃহীত

ক্রিস্টোফার নোলানের তৈরি সিনেমা ‘ওপেনহাইমার’ নিয়ে ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে তুমুল আলোচনা। নেটিজেনদের মধ্যে কাজ‌ করছে এক অন্য রকম রোমাঞ্চ। কিন্তু ‘ওপেনহাইমার’ কি শুধু একটি চরিত্র?

ব্যক্তি ওপেনহাইমার

পারমাণবিক বোমার জনক জে রবার্ট ওপেনহাইমার ১৯০৪ সালের ২২ এপ্রিল নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন জার্মান অভিবাসী এবং তিনি টেক্সটাইলশিল্পে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করতেন। ওপেনহাইমার ছোট থেকেই অনেক প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে তিনি পদার্থ ও রসায়নে জ্ঞান অর্জন করেন। ১৯২৫ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন শেষে গবেষণাকর্মের জন্য ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে লর্ড আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের তত্ত্বাবধানে আণবিক গঠন বিষয়ে গবেষণা চালান। এ ছাড়া তিনি বিজ্ঞানী বোরসহ আরও বড় ব্যক্তিদের সংস্পর্শে থেকে গবেষণাকাজ চালাতে থাকেন। ১৯২৭ সালে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৩৪ সালের দিকে তিনি রাজনীতিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। হিটলারের ক্ষমতা পাওয়ার পর তাঁর রাজনৈতিক দিকে আগ্রহ বাড়তে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাজনৈতিক বিষয় ও বিজ্ঞানকে এক সুতায় বেঁধে কাজ করেন ওপেনহাইমার। ব্যক্তি ওপেনহাইমার ছিলেন একজন ধূমপায়ী।

ম্যানহাটান প্রজেক্ট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হয়েছিল ম্যানহাটান প্রজেক্টের সফলতার হাত ধরে। ১৯৩৯ সালে জার্মানি পোল্যান্ড দখল করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন একটি গুজব প্রচলিত ছিল যে হিটলার পারমাণবিক শক্তির দিকে তাঁদের পরিকল্পনা তৈরি করছেন, যা ছিল মার্কিনদের জন্য একটি ভীতির কারণ। জার্মানি যদি কোনোভাবে প্রথম পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার শুরু করে দেয়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয় প্রায় অসম্ভব। সে সময় ইউরোপের অনেক বিজ্ঞানী জার্মানিতে পাড়ি দেন। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন তৎকালীন মার্কিন সরকারকে এ বিষয়ে অবগত করেন। মার্কিন সরকার পরবর্তী সময় পারমাণবিক গবেষণার প্রকল্প অনুমোদন দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি ১৯৪২ সালে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী, গণিত ও পদার্থবিদদের নিয়ে শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের টপ সিক্রেট অপারেশন ‘ম্যানহাটান প্রজেক্ট’। যাত্রা শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ও সফল পারমাণবিক বোমা গবেষণা প্রকল্পের।

প্রকল্পটির কেন্দ্র ছিল নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটান নামক স্থানে। এ ছাড়া টেনেসির ওক রিজে, ওয়াশিংটনের হ্যানফোর্ড এবং নিউ মেক্সিকোর লস আলামস—এই তিন স্থানেও গোপন গবেষণাকেন্দ্র ছিল। এ প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার লেজলি রিচার্ড গ্রোভস এবং লস আলামসের ল্যাবের বৈজ্ঞানিক পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার। তার ল্যাবের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘প্রজেক্ট ওয়াই’। প্রকল্পটি মার্কিন সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছিল। এ প্রকল্পে এক হাজারের বেশি বিজ্ঞানী কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন—নিলস বোর, জেমস চ্যাডউইক, এনরিকো ফের্মি, রিচার্ড ফাইনম্যান, আর্নেস্ট লরেন্স, জন ফন নিউমান, লিও জিলার্দ, এডওয়ার্ড টেলার।

ছবি: সংগৃহীত

তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ওপেনহাইমার তাঁর ওয়াই ল্যাবে পারমাণবিক বোমার ডিজাইন ও পদ্ধতি অনুসন্ধান করতে থাকেন। বোমা বানানোর জন্য তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন ইউরেনিয়াম মৌলটিকে। ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর তিনটি আইসোটোপ।

উরেনিয়াম-২৩৮, ইউরেনিয়াম-২৩৪ ও ইউরেনিয়াম-২৩৫, তবে এগুলোর মধ্যে কেবল ইউরেনিয়াম-২৩৫ দিয়ে পারমাণবিক বোমা বানানো সম্ভব। কিন্তু পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ইউরেনিয়াম-২৩৮ মৌলটি এবং ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর পরিমাণ মোট ইউরেনিয়ামের শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। প্রতি ১০০ থেকে ২০০ টন ইউরেনিয়ামে প্রায় ১ ভাগের কাছাকাছি ইউরেনিয়াম-২৩৫ পাওয়া যায়। অর্থাৎ, তখন বোমা বানালে বোমার ওজন ৫০ থেকে ২০০ টনের কাছাকাছি হবে, যা বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সে ক্ষেত্রে যে করেই হোক, ইউরেনিয়াম-২৩৮-কে বিভাজিত করে ইউরেনিয়াম-২৩৫-এ রূপান্তরিত করতে পারলে মাত্র কয়েক কেজি দিয়ে পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলা সম্ভব।

১৯১১ ও ১৯১৩ সালে বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড ও বোর তাদের পরমাণু মডেল আবিষ্কার করেন। বিজ্ঞানীদের পরমাণু ধরে ইউ-২৩৮ থেকে ইউ-২৩৫ পৃথক করার একটি কার্যকর পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাসায়নিক পদ্ধতি কাজে আসবে না। কারণ, রাসায়নিকভাবে ইউ-২৩৮ ও ইউ-২৩৫ একই মৌল। এদের ভৌত কোনো উপায়ে পৃথক করতে হবে। পরবর্তী সময় কলকারখানায় ১০ কেজি ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর সাহায্যে গবেষণা চলতে থাকে।

মূলত নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া একটি ফিশন বিক্রিয়া। কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করলে এটি বিভাজিত হয়ে নতুন পরমাণুতে পরিণত হবে এবং একই সঙ্গে তীব্র শক্তি উৎপাদন করবে, যা আবার পরবর্তী মৌল ভাঙতে কাজে লাগবে। এটি একটি শিকল বিক্রিয়া। এটি চলতে থাকবে এবং একই সঙ্গে তীব্র শক্তি ও তাপ উৎপাদন করবে।

ম্যানহাটান প্রকল্পের মাধ্যমে চারটি পারমাণবিক বোমা বানানো হয়েছিল। এর মধ্যে ট্রিনিটি নামের প্রথম বোমাটি নিউ মেক্সিকোর আলামোগোর্ডোর কাছে ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাইয়ে পরীক্ষামূলকভাবে বিস্ফোরিত করা হয়।‌ এটি সফল হয়েছিল। শান্ত মরুভূমি মুহূর্তের মধ্যে তীব্র আগুনের গোলায় পরিণত হয়েছিল। প্রতিপক্ষের চোখ ধুলা দিতে বিবৃতি দেওয়া হয়, এটি একটি সামরিক অভিযান ছিল। পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ সফল হওয়ার পর ওপেনহাইমার বলেছিলেন, ‘এখন আমি মৃত্যুর কারণ হতে পারি, বিশ্বকে ধ্বংস করে দিতে পারি।’

একটি পারমাণবিক বোমার এক লাখ টন টিএনটির শক্তি মজুত থাকে, যা মুহূর্তের মধ্যে অর্ধ মিলিয়ন মানুষকে মেরে ফেলতে সক্ষম।

ছবি: সংগৃহীত

ছোট বালক ও মোটা মানুষ

ম্যানহাটান প্রজেক্টে যে চারটি বোমা বানানো হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে ‘ট্রিনিটি’-কে পরীক্ষামূলক বিস্ফোরিত করা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধে ব্যবহৃত প্রথম পারমাণবিক বোমা ছিল ‘ইউরেনিয়াম গান’, যার সাংকেতিক নাম ছিল ‘লিটল বয়’। বোয়িং বি-২৯ বিমানে বহনকারী বোমাটি ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর নিক্ষেপ করা হয়। ১৫ হাজার টন টিএনটির সমান শক্তিসম্পন্ন বোমাটি মুহূর্তের মধ্যে ৬০ থেকে ৮০ হাজার মানুষকে মেরে ফেলে এবং এর তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে ক্যানসারসহ অন্যান্য শারীরিক জটিলতা ও পঙ্গুত্ব বরণ করে লক্ষাধিক মানুষ। পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে করা হয় যে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বোমা নিক্ষেপের খবর শুধু সাত থেকে আটজন জানত।

এর তিন দিন পর প্লুটোনিয়াম কোর দিয়ে বানানো বোমা ‘ফ্যাটমান’ নাগাসাকিতে নিক্ষেপ করা হয়। ৪০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যান এবং ৮০ হাজারের বেশি মানুষ পঙ্গু হয়ে যান। দুটি শহরেই এখনো তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব রয়েছে।

এবং ম্যানহাটান প্রকল্পের চতুর্থ ও শেষ বোমাটি জাপানের দিকে তাক করে রাখা হয় এবং জাপান আত্মসমর্পণ করে। এ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ওপেনহাইমার

১৯৪৬ সালের দিকে ম্যানহাটান প্রজেক্ট আণবিক শক্তি কমিশনের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ওপেনহাইমারকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পরামর্শকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিরও পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তবে তাঁর সঙ্গে রাশিয়ার যোগসূত্র রয়েছে এবং তিনি তথ্য পাচার করেন—যুক্তরাষ্ট্রের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তাবিষয়ক শুনানিতে ওপেনহাইমারকে‌ যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ থেকে অব্যাহতি‌ প্রদান করা হয়। এই ঘটনার পর তৎকালীন বিজ্ঞানীরা তাঁর পক্ষে অবস্থান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতি তীব্র নিন্দা জানান এবং তাঁদের মধ্যে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন একজন।

১৯৬৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন ওপেনহাইমারকে আণবিক শক্তি কমিশনের প্রদানকৃত এনরিকো ফার্মি পুরস্কার প্রদান করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ইনস্টিটিউট ফর স্টাডি থেকে অবসর নেন। এরপর গলার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৬৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৬২ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে দেহাবসান ঘটে তাঁর। আধুনিক বিজ্ঞান ও‌ গবেষণায় চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন ওপেনহাইমার।

লেখা: সাদমান সাদিক শোভন